রাজধানীর নয়াপল্টন গতকাল ছিল প্রতিবাদে উত্তাল। ছাত্র-জনতার মিছিল, মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল পল্টন, বিজয়নগর, নাইটিঙ্গেল, কাকরাইল, প্রেস ক্লাব থেকে মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত এলাকা। ‘জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘গুপ্ত হত্যা বন্ধ কর, মব কালচার বন্ধ কর, ষড়যন্ত্র বন্ধ কর’ স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং বিএনপি ঢাকা মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ শাখাসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের লক্ষাধিক নেতা-কর্মী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
ঢাকা মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ বিএনপির এ সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনা অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা নির্বাচন বানচাল করতে এ মব তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এ থেকে কয়েকটি দল রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ‘ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের’ প্রতিবাদ এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে সংঘটিত ‘পাশবিক হত্যাকান্ডের’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিকালে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। অন্যদিকে একই স্থানে দুপুরে গোপন তৎপরতায় দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত গুপ্ত সংগঠনের মব সৃষ্টির অপচেষ্টা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট করা এবং সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
যুবদলের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিশেষ অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি রফিকুল আলম মজনুর সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিনের পরিচালনায় সমাবেশে মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হকও বক্তব্য দেন। এ ছাড়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, আবদুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, মহানগরী উত্তরের সদস্যসচিব মোস্তফা জামান, যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিকালে ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির যৌথ সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এখন একটাই- ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। যেটা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন। এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মিটফোর্ডের ঘটনা কেন্দ্র করে কয়েকটি রাজনৈতিক দল, কয়েকটি চক্র দেশের রাজনীতি একেবারে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। এ চক্রান্ত নতুন নয়, এ ষড়যন্ত্র নতুন নয়। যখনই বাংলাদেশের মানুষ উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে, ঠিক সে সময়ই ষড়যন্ত্রকারীরা দেশকে আবার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা চেষ্টা করছে বাংলাদেশে যেন নির্বাচন না হয়। মানুষ যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে।’ দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ছাত্রদলের মিছিলটি শুরু হয়ে কাকরাইলের মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়।
মিছিল শুরুর প্রাক্কালে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির অভিযোগ করে বলেন, ‘মিটফোর্ডের হত্যাকা কেন্দ্র করে কথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে ছাত্রদলের বিপক্ষে মব সৃষ্টি করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, তারা আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামেও বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা তৈরি করেছে। গত এক সপ্তাহে আরও কয়েকটি জঘন্য হত্যাকা হয়েছে। এগুলো নিয়ে তারা কোনো শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করেনি। শুধু মিটফোর্ডের ঘটনা নিয়ে শিবিরের গুপ্ত কর্মীরা মব সৃষ্টি করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা চেষ্টা করছে বাংলাদেশে যেন নির্বাচন না হয়। মানুষ যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে।’
এদিকে সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অশ্লীল ভাষায়, কুরুচিপূর্ণভাবে আমার নেতা তারেক রহমান সম্পর্কে তারা কথা বলেছে, স্লোগান দিয়েছে। তারা ভেবেছিল কথাগুলো বললে, স্লোগান দিলে বিএনপি বোধহয় ঘরের মধ্যে ঢুকে যাবে। বিএনপি বারবার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, সব আঘাত প্রতিহত করে উঠে দাঁড়িয়েছে, বিএনপি হচ্ছে ফিনিক্স পাখির দল।’ তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান যখন এ রাষ্ট্রকে টেনে ওপরে তোলার জন্য, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য, লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থানের জন্য সব বিজ্ঞ লোকের সঙ্গে কথা বলছেন, পরিকল্পনা তৈরি করছেন; ঠিক সেই সময় তারা আঘাত করছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনাটা অত্যন্ত ভয়াবহ। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে আবার একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অস্থিরতা তৈরি করা, বিভাজন সৃষ্টি করা; যেখানে গণতন্ত্রের আবার কবর রচিত হবে।’ দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা কারও পাতা ফাঁদে যেন পা না দিই। তারা চেষ্টা করছে আমাদের উত্তেজিত করে তাদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার জন্য। যাতে আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই। আমরা যেন উত্তেজিত না হই, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র চাই। যখনই লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে তারেক রহমান নিশ্চিত করে ফেলেছেন যে এবার নির্বাচন হবে। তখন থেকেই তাদের মাথা বিগড়ে গেল। আমাদের ধৈর্য ধরে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।’
পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। মিছিলটি কাকরাইল, মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, কার্জন হল, টিএসসি হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়।
সমাবেশে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতাকে নিয়ে অশ্লীল স্লোগান দেওয়ার পরও নেতা-কর্মীদের শান্ত রাখা হয়েছে। আমরা সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে এ ধরনের অস্থিতিশীল কোনো ঘটনায় যদি ক্যাম্পাস ক্রস ইস্যু করা হয় এবং মব ক্রিয়েট করা হয়, এর দায়দায়িত্ব ওই গুপ্ত সংগঠনকে বহন করতে হবে।’
জামায়াত, চরমোনাই পীর ও এনসিপির কড়া সমালোচনা মির্জা আব্বাসের : রাজধানীর মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যাকাণ্ডে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনায় গ্রেপ্তার মাহিনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ছবি রয়েছে, বিএনপির সঙ্গে নয়।’ বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ভিডিও পরিকল্পিতভাবে বানানো বলে মনে হচ্ছে। তা সামনে এনে বিএনপিকে ঘায়েল করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে অন্যদের সংশ্লিষ্টতা ধরা পড়ে গেছে। এনসিপির নেতাদের সঙ্গে মাহিনের ছবি স্পষ্ট প্রমাণ করে হত্যাকাণ্ডের দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র চলছে। চরমোনাই পীরের সমালোচনা করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম মানুষ বলছে-চরমোনাই পীর সাহেবের নাকি কোনো ইলম নেই। কোরআন, হাদিস পড়ে নাই। অকাট মূর্খ একটা লোক। কলিজায় জোর থাকলে এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। আমরাও জানতে চাই-আপনি ধর্মীয়ভাবে কোথা থেকে পাস করেছেন?’ আর জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘আরেকটি দল যারা লম্বা লম্বা কথা বলা ছাড়া আর সুকৌশলে হাদিয়া নেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এরশাদের সময় এরশাদের কাঁধে ভর করেন, আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করেন। আর এখন লম্বা লম্বা কথা বলেন। এখন বিএনপি ওনাদের একমাত্র মাথাব্যথা।’
বিক্ষোভ মিছিল ঘিরে নেতা-কর্মীদের ব্যাপক শোডাউন : কর্মসূচি ঘিরে শোডাউন করেন নেতা-কর্মীরা। ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের সদস্যসচিব মোস্তফা জামান, দক্ষিণের সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবীন, মহানগরী বিএনপি নেতা আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, উত্তরের যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. আফাজ উদ্দিন, হাজি মো. ইউসুফ, মহানগরী দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন সরদার, মহানগরী দক্ষিণ শ্রমিক দলের আহ্বায়ক মো. সুমন ভূইয়া, সদস্যসচিব বদরুল আলম সবুজসহ মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।