স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে ২০২৬ সালে উত্তরণের কথা থাকলেও দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ সময়সীমা পিছিয়ে ২০৩২ সাল পর্যন্ত করার দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া দ্রুত উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ অর্থনীতির নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘এলডিসি থেকে উত্তরণে : আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি), এফবিসিসিআইসহ ১৬টি জাতীয় ব্যবসায়ী সংগঠন। এতে উপস্থিত ছিলেন আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, সহসভাপতি এ কে আজাদ, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ প্রমুখ।
মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা উত্তরণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। তবে টেকসই উত্তরণের জন্য আরও অন্তত তিন থেকে পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর, রপ্তানি বৈচিত্র্য, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং গুণগত মানসম্পন্ন বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের নির্ধারিত মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক এই তিনটি শর্ত টানা দুবার পূরণ করায় বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে আনুষ্ঠানিক উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে জাতীয় গৌরবের বিষয়। তবে সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া উত্তরণ হলে নতুন সুযোগের বদলে তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আগেভাগে উত্তরণ হলে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে বাংলাদেশি পণ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বড় বাজারে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। এতে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ট্রিপস ওয়েভারের সুবিধা শেষ হয়ে যাবে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ক্যানসার ও ভাইরাসজনিত রোগের ওষুধের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। রুলস অব অরিজিন কঠোর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পোশাক খাত, যা বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশ জোগান দেয়।
সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হবে, বাজারভিত্তিক ব্যয়বহুল ঋণ নিতে হবে, এতে ঋণ শোধের চাপ আরও বাড়বে। বাংলাদেশি ওষুধ দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মেটাচ্ছে এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে পেটেন্ট ছাড় না থাকলে ক্যানসারের ওষুধ ইমাটিনিবের দাম মাসে ৩০-৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২-৩ হাজার ডলার হতে পারে। একইভাবে এইচআইভি ওষুধের দাম বছরে ১০০-১৫০ ডলার থেকে বেড়ে ১০-১২ হাজার ডলার হতে পারে। রপ্তানির প্রধান ভরসা তৈরি পোশাক খাত এলডিসি-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় চাপে পড়বে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে উৎপাদন খরচ বাড়বে ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। এ কারণে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা এবং পোশাকের বাইরে নতুন খাত শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণকে সমর্থন করলেও সফল ও টেকসই উত্তরণের জন্য অতিরিক্ত ৩-৫ বছর সময় চেয়েছেন। তাদের মতে, এই সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, আসিয়ান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে এফটিএ করা যাবে। ওষুধ, আইটি, চামড়া, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশলে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যাবে। গুণগত মানসম্পন্ন এফডিআই আকর্ষণ এবং জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বক্তারা বলেন, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার। খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা আর্থিক খাতকে দুর্বল করছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের এফডিআই কমে ১২৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যেখানে ভিয়েতনাম পেয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংকট, লজিস্টিকস খরচ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে আরও দুর্বল করছে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, স্মার্ট বাণিজ্য কূটনীতির মাধ্যমে বাজার রক্ষা; প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অবকাঠামো উন্নয়ন; বিকল্প ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করা; আধুনিক লজিস্টিকস ও কানেকটিভিটি উন্নয়ন; বিনিময় হার ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা; বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসা সহজীকরণ করা গেলে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। ব্যবসায়ীরা আরও স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ করবেই, তবে সফলতা নিশ্চিত নয়। সফল উত্তরণ নির্ভর করছে কত দ্রুত ও সমন্বিতভাবে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি তার ওপর। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণকে চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এক বিরাট সুযোগে পরিণত করতে পারবে। এতদিন পৃথকভাবে এ দাবি জানালেও এবার একযোগে ১৬টি শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন একমত হয়ে সময় বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি); ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই); বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই); বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ); ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই); বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি); বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই); মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই); বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ); বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি); চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই); তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ; বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন; ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই); নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)।