একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর সাংবিধানিক বিধানগুলো কার্যকরের প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন তাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশের কথা উল্লেখ করে বলেছে, বিশেষজ্ঞদের প্যানেল প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদের ২২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে একটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ জারি করতে পারে, যেখানে জুলাই সনদে উল্লিখিত মৌলিক সংস্কারগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ আদেশ তাৎক্ষণিক কার্যকর হবে। এরপর সেই সাংবিধানিক আদেশের ওপর গণভোট হতে পারে, যা অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই। সাংবিধানিক আদেশে গণভোটের বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যদি গণভোটে জনগণের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে সাংবিধানিক আদেশ জারির তারিখ থেকে সেটা বৈধতা পাবে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ প্রস্তাব তুলে ধরেন। তবে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা মতদ্বৈধতা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে সংলাপে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন তাঁরা। সংলাপ চলাকালে একই ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি ঘোষণা করায় ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। তাঁদের দাবি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজনৈতিক দলগুলো। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুসরণের প্রস্তাব করেছেন অনেকেই। এদিকে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে এ নিয়ে বিতর্ক বেশিদূর এগোয়নি বলে জানান রাজনীতিবিদরা।
রাজপথে পিআর আদায় করা যাবে না, আমরাও রাজপথে বক্তব্য দেব
-সালাহউদ্দিন আহমদ
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে আগামী এক মাসের মধ্যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পাশাপাশি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের মাধ্যমে করতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর যেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা যাবে, তা যেন সরকার দ্রুত সম্পন্ন করে, সে পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কমিশনের মেয়াদ এক মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা কোনো অবস্থায়ই এক মাস সময় নিয়ে এ আলোচনা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী নই।’ রাজনৈতিক দলগুলো ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে একমত হতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পক্ষ থেকে সংবিধানসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাস্তবায়নে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে গণভোট, আরেকটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের কথা। আমরা সরকারকে একাধিক পরামর্শ দিতে পারি বাস্তবায়নের জন্য, সেটা তুলনামূলকভাবে সরকারের জন্য সহজতর হবে, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে তারা পদক্ষেপ নিতে পারবেন।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য ২১ সেপ্টেম্বর থেকে নিউইয়র্কে থাকবেন। তিনি ফিরবেন ২ অক্টোবর। আমরা এ প্রক্রিয়াটির পরিণতির জায়গা, অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে যে সুপারিশ সেটা পেলে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে দিতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দুজন করে প্রতিনিধির নাম পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। বেশির ভাগ দলই তা পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেবে।’ খুব স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতেই সনদ স্বাক্ষরের জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বৈঠক শেষে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বৈঠকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অভিমত উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সরকার সাংবিধানিক কি না? কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সংবিধান মেনে এ সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সনদের যেসব বিষয় সংবিধান সম্পর্কিত, তা বাস্তবায়নের আগে বিচার বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কিন্তু জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা ঠিক হবে না।’
সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা বলেন, ‘সবাই মত দিলে বিবেচনা করা যায়। তবে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সনদে স্বাক্ষর করেই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। এমন কিছু মৌলিক সংস্কারমূলক বিষয় আছে, যা বাস্তবায়নে সংসদীয় গণভোটেরও প্রয়োজন হতে পারে। তাহলে একই বিষয়ে দুবার গণভোটের প্রয়োজন কেন? এসব বিষয় আলোচনার টেবিলেই নির্ধারিত হওয়া উচিত।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে এবং সংসদ গঠনের পর মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় গণভোট আয়োজনের বিষয়টিও তখন বিবেচনায় আনা যাবে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিআর নিয়ে যারা রাজপথে আন্দোলন করছেন, তা কমিশনের এজেন্ডায় ছিল না। সবার রাজনৈতিক অধিকার আছে যে কোনো বিষয়ে দাবি জানানোর, আমরাও রাজপথে আমাদের বক্তব্য দেব। তবে রাজপথে তো পিআর আদায় করা যাবে না, আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। আলোচনার টেবিল রেখে রাজপথে যাওয়া স্ববিরোধিতা। আর এসব কারণে যদি নির্বাচন অনিশ্চিত বা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং অসাংবিধানিক শক্তি লাভবান হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে, এরপর সে বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এ গণভোট হবে। আমরা চাই জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দেওয়া হোক। এতে সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। কেউ কেউ বলছেন এটা নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা মনে করি সেটা সম্ভব। শুধু ব্যবস্থাপনার ব্যাপার।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য না হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারাই গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে, কতটুকু সংস্কার হবে, কী কী সংস্কার হবে।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এ সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাব।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে উসকে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে?’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে জুলাই ঘোষণার ২২-এর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫-এর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষমতায় আছে, সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এমন কোনো পথ নেওয়া উচিত নয়, যাতে বোঝা যায় তা কোন কর্তৃত্বের মাধ্যমে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া দরকার।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, ‘সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে পাস করতে হবে। আর একমত হওয়া বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে হবে। তা ছাড়া সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি গণভোট সমস্যা আরও বাড়াবে।’