বিগত তিন বিতর্কিত নির্বাচনের অভিযোগ তদন্তে শুরুতেই তলব করা হচ্ছে তিন নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের। বিচারপতিদের জেরার মুখে পড়বেন তাঁরা। ব্যাখ্যা দিতে হবে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অনিয়ম ও কারচুপির। তাঁদের জেরার পরিপ্রেক্ষিতে তলব করা হবে অন্য জড়িতদের। প্রথমে চারজন সিনিয়র জেলা জজ ও জেলা জজ নিয়ে কমিশন কাজ করার পরিকল্পনা করলেও এখন তা পরিবর্তন করা হয়েছে। বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০ সদস্যের টিম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কমিশনে একজন সিনিয়র জেলা জজ ও দুজন জেলা জজ কাজ শুরু করেছেন। কমিশনের পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও সাত বিচারক চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বরের মধ্যেই তদন্ত কমিশন তাঁদের কাজ শেষ করতে চান।
কমিশনসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রায় ৫০ সদস্যের লোকবল নিয়ে কমিশন তাঁদের কাজ শুরু করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ওই টিম তৈরি করা হয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেননি। তবে সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকারের কাছে কমিশন আরও এক মাস সময় চাইবে। ওই সময়ের মধ্যে তিন নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে পারবেন কমিশন। সংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্তের শুরতেই তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের তলব করা হবে। তাঁরা কমিশনসংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের জেরার মুখোমুখি হবেন। তাঁদের জেরার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যদের তলবের সিদ্ধান্ত নেবেন কমিশন। এজন্য খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না বলে জানান তাঁরা। কারণ এরই মধ্যে নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকা চাওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। শিগগিরই তারা ওই তালিকা তদন্ত কমিশনকে দেবে।
পাঁচ সদস্যের এ কমিশনের সভাপতি করা হয়েছে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে। কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব শামীম আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক, আইনজীবী তাজরিয়ান আকরাম হোসাইন এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম।
কমিশনের রিপোর্টে যাঁরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কার্যক্রমে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারবেন তাঁরা। এমন ক্ষমতা নিয়েই কাজ শুরু করেছেন কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রথমে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে কমিশন গঠন করা হয়। ২৯ জুলাই এ নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। পাঁচ সদস্যের কমিশনকে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ২ নম্বর ব্লকে অফিস সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে জারি করা গেজেটে বলা হয়েছে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ তিনটি নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এসব নির্বাচনে নানান কৌশলে জনগণের ভোট দেওয়ার অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে সাজানো প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ দলকে নির্বাচিত করার জোরালো অভিযোগ রয়েছে।
কমিশনের কার্যপরিধিতে নয়টি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, দেশিবিদেশি তদারকি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যমে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ বিশ্লেষণ করবেন। এসব নির্বাচনের বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এবং সার্বিকভাবে উল্লিখিত বিষয়সমূহের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করবেন কমিশন। রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ ও জনগণের ভোটাধিকার প্রদান বাধাগ্রস্ত করতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করবেন। নির্বাচনগুলোর তৎকালীন নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে। নির্বাচন কার্যক্রমে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনসমূহের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আর্থিক অনিয়মের অভিযোগগুলো যাচাই ও অনুসন্ধান করা হবে। বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উল্লিখিত নির্বাচনসমূহে অনিয়মের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করবেন কমিশন। ভবিষ্যতের সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন পর্যায়ে উপনীত করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত সুপারিশ দেওয়া হবে। প্রয়োজনে যে কোনো দপ্তরের দলিলদস্তাবেজ তলব ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন কমিশন।