বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই সনদের কিছু দফা অগোচরে পরিবর্তন করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ও সুপারিশগুলো একপক্ষীয় এবং জোরপূর্বক জাতির ওপর চাপানো হচ্ছে। যে কোনো আদেশ রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিসে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানোর বিধান বিলুপ্ত করার বিষয়টি জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
রাজধানীর গুলশানে গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। এ সময় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব লিখিত বক্তব্যে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশে প্রতীয়মান হয়- দীর্ঘ এক বছর সংস্কার কমিশন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, টাকা ও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনা ও সুপারিশগুলো একপক্ষীয় এবং জোরপূর্বক জাতির ওপর চাপানো হচ্ছে। স্বাক্ষরের পর বেশ কিছু দফা অগোচরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এটা কমিশনের নিরেট প্রতারণা। এসব সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে, অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে আনতে পারে। যেসব দফায় সবাই সম্মত হয়েছিল, তার মধ্য থেকে কিছু দফা অগোচরে পরিবর্তন করা হয়েছে। দফা অনুযায়ী প্রস্তাবনাগুলো ২৭০ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে- তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি হাতে পাওয়ার পর দেখলাম- ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে। যেমন ক. মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি অফিসে টাঙানোসংক্রান্ত বিধান [অনুচ্ছেদ ৪(ক)] বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে সম্মতিপত্র দিয়েছে। খ. সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটি চূড়ান্ত সনদ থেকে বাদ দিয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরূপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২ ও সংযুক্তি-৩-এ সংযোজন করা হয়েছে। সরকারের এ রকম আদেশ জারি করার এখতিয়ার নেই। সংবিধানের ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে ‘আদেশ’ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। অতএব তা জারি করা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট জুলাই সনদের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি। বাস্তবায়ন আদেশে (সুপারিশ) বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে অভিহিত হবে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল না। আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না। এ জাতীয় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করতে হলে তা-ও পরবর্তী জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলা হয়েছে, উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায়, তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠান হওয়ার আগে এ ধরনের আগাম পদক্ষেপ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
গণভোট প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে প্রস্তাবিত গণভোট করা সম্ভব নয়। সময়স্বল্পতা, বিপুল অঙ্কের ব্যয়, ব্যাপক লোকবল নিয়োগ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে ও একই ব্যয়ে সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট করা বাঞ্ছনীয়।
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন সহজভাবে প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ উল্লিখিত যেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধিবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন দরকার, সরকার তা অধ্যাদেশ জারি ও বিধিবিধান/সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে পারে। যেসব সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য তাঁরা গণভোটে সম্মত হয়েছেন। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে এবং দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ একেবারেই আলোচনায় আসেনি, সেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সব সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় তাঁরা একমত হতে পারছেন না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, কমিশনের ধারাবাহিক আলোচনায় কিছু বিষয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট সহকারে ঐকমত্য হয়েছে। জুলাই সনদ যেভাবে প্রণীত হয়েছে, তাতে নোট অব ডিসেন্টের অংশে এই বক্তব্য স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে ভিন্নমত নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে তা উল্লেখ করে যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সে মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁরা কেবল আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু সেদিন জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত কপি তাঁদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরবর্তী সময় মুদ্রিত পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি তাঁরা হাতে পাওয়ার পর দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা তাঁদের অগোচরে আবার সংশোধন করা হয়েছে।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        