শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঘুরে বেড়াই

বৈচিত্র্যময় দিনাজপুর

মায়াবী নয়নাভিরাম স্বপ্নপুরী; কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর-রাজবাড়ী...

বৈচিত্র্যময় দিনাজপুর

ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর-রাজবাড়ী সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যমণ্ডিত দিনাজপুরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ছোট নাগপুর, বিন্ধ্যা পর্বত প্রভৃতি লাখ লাখ বছরের প্রাচীন স্থানগুলোর মৃত্তিকার সমগোত্রীয় দিনাজপুরের মাটি। বহুকাল আগে হিমালয় পর্বতের ভগ্নিরূপে জন্ম নেওয়া বরেন্দ্র ভূমির হৃদয়-স্থানীয় স্থান দিনাজপুর। লোকশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই রাজবাড়ীতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরে ব্রিটিশ শাসকরা ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে জেলার নামকরণ করেন দিনাজপুর। বাংলাদেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনায় সৃষ্ট আদি জেলা শহরগুলোর অন্যতম দিনাজপুর। ইংরেজ সেনারা পলাশী যুদ্ধের আট বছর পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে এ এলাকা জয় করে। ফলে নবাবী শাসনের অবসানের সঙ্গে পতন হয় সাবেক রাজধানী ঘোড়াঘাট নগরের। তারপর থেকে গড়ে উঠতে শুরু করে দিনাজপুর শহর। আর এ শহরের নানা পৌরাণিক কাহিনী জন্ম নেয়। যার নিদর্শন আজও রয়েছে। এসব নিদর্শন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।

কীভাবে যাবেন : দিনাজপুর থেকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রেলওয়ে ছাড়াও সড়কপথও রয়েছে। রেলওয়ে পথে দিনাজপুর-ঢাকা রুটে সরাসরি আন্তঃনগর একতা ও দ্রুতযান নামে দুটি ট্রেন রয়েছে। সড়কপথে রয়েছে এসি-নন-এসি বিভিন্ন কোচ। প্রাচীনতম জেলা সদর থেকে প্রত্যেক উপজেলার সঙ্গে রয়েছে বাস সার্ভিস। শহরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রিকশা ও অটোরিকশা রয়েছে।

কোথায় থাকবেন : দিনাজপুর শহরের এসি-নন-এসি আবাসিক ভালো মানের হোটেল আছে। আছে ভালো মানের পর্যটন হোটেল-মোটেল। হোটেলের মান অনুযায়ী রুম ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। আগে থেকে বুকিং করার ব্যবস্থা রয়েছে।

দর্শনীয় স্থানসমূহ : দিনাজপুর শহরের পূর্বদিকে ঐতিহাসিক রাজবাড়ী, উত্তরদিকে চেহেলগাজী মাজার, দক্ষিণে রামসাগর দিঘি। এ ছাড়া নবাবগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে আশুড়ার বিল, স্বপ্নপুরী, বৌদ্ধবিহার, ঘোড়াঘাট উপজেলায় ঘোড়াঘাট দুর্গ, সুরা মসজিদ, বারপাইকরের গড়, পাঁচ পীরের দরগাহ, কাহারোল উপজেলায় ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দির, নয়াবাদ মসজিদ, দীপশিখা মেটিস্কুল, খানসামা উপজেলায় ঐতিহাসিক আওকরা মসজিদ, বীরগঞ্জ উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন সিংড়া ফরেস্ট জাতীয় উদ্যান, বিরল উপজেলায় সীমান্ত ঘেঁষে ধর্মপুর বনবিট, কড়াই বিল উল্লেখযোগ্য।

মায়াবী নয়নাভিরাম স্বপ্নপুরী : দিনাজপুর শহর থেকে সড়কপথে ৫২ কিলোমিটার দূরে নবাবগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর কুশদহ ইউপির খালিশপুর মৌজায় এবং ফুলবাড়ী উপজেলা শহর থেকে স্বপ্নপুরীর দূরত্ব ১২ কি.মি। স্বপ্ন নয়, অথচ স্বপ্নের মতো সুন্দর নিরিবিলি নয়নাভিরাম মায়াবী স্বপ্নময় ভুবন স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরীর গেটে এসে পৌঁছলে স্বাগত জানাবে দণ্ডায়মান দুটি বিশাল আকৃতির পরীর প্রতিকৃতি মূর্তি। এ দুটি পরী তাদের দুই ডানা প্রসারিত করে ও একহাত উঁচু করে গেটের দুই পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখে পড়বে পথের দুই ধারে সারি সারি দেবদারু গাছ। যেন এক মোহন-মায়াবী স্বপ্নিল ভুবন। এখানে রয়েছে নিশিপদ্ম, নীলপরী, সন্ধ্যাতারা, রজনীগন্ধা মেঠো ঘর এবং ভিআইপি কুঞ্জ নামের একাধিক মনোমুগ্ধকর ডাকবাংলো।

কাহারোলের ঐতিহাসিক কান্তজিউ মন্দির : দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ২০ কি.মি উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে ৭ কি.মি পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে ঢেপা নদীর তীরে টেরাকোটা অলঙ্কারের কান্তজিউ মন্দির অবস্থিত। ভাস্কর কৌশল ও আপন মহিমায় নয়নাভিরাম কান্তজিউ মন্দির। প্রায় ৬২.৪৬ একর জায়গাজুড়ে বেষ্টনীর মধ্যে প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে মন্দিরটি স্থাপিত। প্রায় ১ মিটার উঁচু এবং ১৮ মিটার বাহুবিশিষ্ট নির্মিত একটি বর্গাকার বেদীর ওপর এ মন্দির নির্মিত। বর্গাকারে নির্মিত ইটের তৈরি মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬ মিটার। তিনতলাবিশিষ্ট এ মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। এ জন্য এটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হয়। শুরুতে মন্দিরের উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। মন্দিরের বাইরে দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে দেবমূর্তির ছবি খোদাই করা রয়েছে এবং পোড়া মাটির চিত্রফলকে রামায়ণ মহাভারত কাহিনীসহ শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী ও সম্রাট আকবরের কিছু চিত্রকর্ম তুলে ধরা হয়েছে। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২৪টি, দ্বিতীয় তলায় ২০টি এবং তৃতীয় তলায় ১২টি দরজা রয়েছে।

 

 

নয়নাভিরাম দিঘি রামসাগর : দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কি.মি দূরে দক্ষিণে নৈসর্গিক ও স্মৃতিময় হয়ে আছে দিনাজপুরের মহারাজাদের কীর্তিময় রামসাগর। অপরূপ নয়নাভিরাম দিঘিটি ভ্রমণকারীদের মনকে ছুঁয়ে যায় ভালো লাগার পরশে। চারদিকে সুউচ্চ মাটির টিবি, মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন দিঘির নীল জলরাশি। পাড়ভূমিসহ এ দিঘির মোট জমির পরিমাণ ১৪৬ একর। দিঘির দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৩৯৯ ফিট এবং প্রস্থ ৯৯৮ ফিট। গভীরতা গড়ে প্রায় ৯ মিটার, সর্বোচ্চ পাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৩৫০ মিটার। রামসাগরের দৈর্ঘ্য ১১৮০ গজ ও প্রস্থ ৩২০ গজ। ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় এখন আর আগের মতো প্রাণচাঞ্চল হয়ে ওঠে না দিঘির পরিবেশ। এ ছাড়াও বাংলোর পাশে একটি ছোট্ট চিরিয়াখানা ও শিশুদের জন্য পার্ক রয়েছে। রামসাগরের একাধিক ছোট ছোট টিনের চালা। 

ঐতিহ্যবাহী নাগ দরজার রাজবাড়ী : দিনাজপুর শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে রিকশা বা অটোরিকশায় আসা যাবে এখানে। এটি মোগল আমলের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। হিন্দু-মুসলিম ও ইংরেজ এ তিন যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের বিচিত্র দৃষ্টিনন্দন এর সমাবেশ এ রাজবাড়ীটি।

রাজবাড়ী অনধিক ৪০০ বছরের পুরনো এবং মূল বাড়িটি ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। চারদিক থেকে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা রাজবাড়ীর অনেকটি প্রবেশদ্বার। এর মধ্যে ধর্মাদেউড়ী, সিংহ দেউড়ী, বেলতলীর দেউড়ী (নাট মন্দিরে যাওয়ার দ্বার), ঠাকুরবাড়ীর দেউড়ী, হাতিশালার দেউড়ী, হীরাবাগ দেউড়ী অন্যতম। রাজবাড়ীর প্রধানত দুটি অংশ- আয়নামহল ও রানীমহল। এ ছাড়াও আছে ঠাকুরবাড়ী ও হীরাবাগ এলাকা। এখানে ছিল রাজকীয় ফুলবাগান, সবজি বাগান এবং পদ্মসাগর, শুকসাগর, আনন্দসাগর, মাতাসাগর ও রামসাগর জাতীয় বৃহৎ দিঘি।

বীরগঞ্জের সিংড়া ফরেস্ট : এক সময়ে বাঘ, নীল গাইসহ বিভিন্ন বন্য জীবজন্তুর অবাধ বিচরণের অভয়ারণ্য ছিল গহিন অরণ্য সিংড়া ফরেস্ট। এখন সুন্দর নিরিবিলি গাছ-গাছালির মোহনীয় প্রকৃতির নয়নাভিরাম সিংড়া ফরেস্ট, যা দর্শনার্থী, পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে নিরিবিলি পরিবেশে মায়াবী হাতছানির এক অনুপম দৃশ্য মহিমান্বিত দিনাজপুরের সিংড়া ফরেস্ট ঠিক যেন স্বর্গের মতো।

মো. রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর প্রতিনিধি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর