বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু। গতকাল সকালে টোকিওতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আশ্বাস দিয়েছেন। বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করেন। তাঁরা জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা সমুন্নত রেখে এই অঞ্চল এবং তার বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে বহুপাক্ষিকতার প্রতি তাঁদের সমর্থনের আশ্বাস দেন দুই নেতা। এদিন বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতাসংক্রান্ত ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। টোকিওতে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’ শীর্ষক একটি সেমিনারের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের উপস্থিতিতে এই সমঝোতা স্মারকগুলো সই হয়। প্রথম সমঝোতা স্মারকটি ছিল জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) এবং বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। দ্বিতীয় সমঝোতা স্মারকটি ছিল অনোডা ইনক ও বাংলাদেশ এসইজেড লিমিটেডের (বিএসইজেড) মধ্যে। তৃতীয় সমঝোতা স্মারকটি ছিল বাংলাদেশ নেক্সিস কো. লিমিটেড এবং বাংলাদেশ এসইজেড লিমিটেডের মধ্যে। চতুর্থ সমঝোতা স্মারকে গ্লাগিট, মুসাসি সিমিতিসু ইন্ডাস্ট্রি গ্লাফিট এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মধ্যে ব্যাটারিচালিত বাইসাইকেল ও বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল তৈরির একটি কারখানা স্থাপনবিষয়ক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে পঞ্চম সমঝোতা স্মারকটি সই হয়েছে কিপার কোর কো. লিমিটেডের সঙ্গে। ষষ্ঠ সমঝোতা স্মারকটি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বিডার মধ্যে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমওইউ স্বাক্ষরকারী সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অভিনন্দন জানান।
এদিকে গতকাল জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা ও গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বিশেষ করে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগসহ (এমআইডিআই) বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প বৃদ্ধি বেল্ট (বিআইজি-বি) উদ্যোগের আওতাধীন প্রকল্পগুলোর জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নে জাপান সরকারের অব্যাহত সহায়তার জন্য ড. ইউনূস জাপানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উভয় পক্ষ বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বিডা’তে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) সিস্টেম, প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন, ব্যাটারিচালিত চক্রের জন্য কারখানা স্থাপন, তথ্য সুরক্ষার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প চালু এবং বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বিএসইজেড) সঙ্গে ভূমি চুক্তিসহ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং সহযোগিতা স্মারক (এমওসি) স্বাক্ষরকে স্বাগত জানায়। তারা পারস্পরিক লাভজনকভাবে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) সম্পন্ন করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। বৈঠকে জাপানের অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্সের (ওএসএ) আওতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে পাঁচটি টহল নৌকা দ্রুত সরবরাহসহ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও জোরদারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসংক্রান্ত চুক্তিতে দুই সরকার নীতিগতভাবে একমত হওয়ায় তারা স্বাগত জানিয়েছেন এবং চুক্তিটি দ্রুত সম্পন্ন করার আশা প্রকাশ করেছেন।
মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের বৃত্তিসহ বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে জাপানের অব্যাহত সহায়তার জন্য অধ্যাপক ইউনূস জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। জাপানের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়ার এবং তাদের জন্য অব্যাহত মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। উভয় পক্ষই অভিমত ব্যক্ত করেছে যে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মিয়ানমারে একটি টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন হলো এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধান।
অধ্যাপক ইউনূস তাঁকে এবং তাঁর প্রতিনিধিদলের প্রতি উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তার জন্য ইশিবা শিগেরু এবং জাপানের জনগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।