হার্টে রিং পরার প্রধান এবং একমাত্র কারণ হলো হার্টের রক্তনালিতে ব্লক দেখা দেওয়া। চিকিৎসক আপনার হার্টের এনজিওগ্রাম করে এক বা একাধিক ব্লক নির্ণয় করেছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার সব ব্লক অথবা কিছুসংখ্যক ব্লকের চিকিৎসার জন্য আপনাকে রিং পরার পরমর্শ দিয়েছেন এবং রিং পরেছেন।
কোনো এককালে, মানে রিং-এর প্রচলন হওয়ার আগে এনজিওগ্রাম আমাদের দেশে চালু ছিল। তখন এনজিওগ্রাম করে ব্লক পাওয়া গেলে সম্ভব হলে ব্লকের স্থানে বেলুন ফুলিয়ে ব্লকের দ্বারা সৃষ্ট রক্তনালির ভিতরে রক্ত প্রবাহের পথে প্রবাহ চিকন হয়ে যেত। বেলুনের মাধ্যমে এ চিকিৎসাকে এনজিওপ্লাস্টি বলা হয়। রিং প্রচলিত হওয়ার পর এর প্রচলন আরও কমে গেছে, তবে এখনো অনেক চিকিৎসক রিং পরানোর পাশাপাশি এনজিওপ্লাস্টি করে থাকেন। এনজিওপ্লাস্টির একটা বড় দুর্বলতা হলো, ব্লকের জন্য বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত বেলুন ফুলিয়ে সাময়িকভাবে ব্লক খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু কিছুদিন পর ফুলানো অংশটা আবার আগের মতো অবস্থায় চলে আসে এবং পূর্বের মতো ব্লক সৃষ্টি করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রিং- এর আবিষ্কার হলো। রিং হলো একটি তার দ্বারা তৈরি এক ধরনের পাইপ, যা মোড়ানো অবস্থায় চিকন হওয়া ব্লকের স্থানে প্রতিস্থাপন করে বাইরে থেকে মোড়ানো তারটি ফুলিয়ে পাইপে রূপান্তরিত করে চিকন রক্তস্রোতকে প্রসারিত করে এবং তা যেন আবার চেপে গিয়ে ব্লকের সৃষ্টি না করতে পারে প্রাথমিক অবস্থায় একে একটা বিশাল চিকিৎসা পদ্ধতি বলে মনে করা হচ্ছিল এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অবদানের জন্য দ্রুত সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে, এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ তো বটেই।
পূর্বেই বলেছি রিং তারের তৈরি মানে ধাতব বস্তু হওয়ায় প্রতিস্থাপিত স্থানে সুড়সুড়ির মাধ্যমে কারও কারও বেলায় আরও ব্লকের সৃষ্টি করে। সারা দুনিয়ার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বসে নেই, তারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে এমন এক ধরনের রিং আবিষ্কার করেছেন, যাতে সংযোজিত মেডিসিন স্বল্প মাত্রায় নির্গমন হয়ে পুনরায় ব্লক সৃষ্টিকে প্রতিহত করে বলে তাদের গবেষণায় প্রমাণিত। এই ধরনের রিং-এ যেহেতু মেডিসিন (ড্রাগ) সংমিশ্রিত থাকে তাই এই ধরনের রিং (স্টেন্ট)কে ড্রাগ ইলুটিং (বিচ্ছুরণ) স্টেন্ট বলা হয়। ড্রাগ ইলুটিং স্টেন্টে বর্তমানে বহুবিধ ড্রাগ সংযোজন করে ভিন্ন ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন ভিন্ন দামে বাজারজাত করছেন। এই ধরনের স্টেন্ট আবিষ্কার হওয়ায় পূর্বে স্টেন্টের একটা নামকরণের প্রয়োজন দেখা দেওয়া ওই স্টেন্টকে বেয়ার (খোলা) মেটাল স্টেন্ট বলা হয়ে থাকে এবং বর্তমান সময়ে এই ক্যাটাগরির স্টেন্টের দামও সর্বনিম্ন।
হার্টের রক্তনালিতে ব্লক সৃষ্টি হওয়ার ফলশ্রুতিতে হার্টে রিং পরানো হয়। যেহেতু আপনার হার্টে রিং পরানো হয়েছে তাই এ থেকে বুঝা যাচ্ছে আপনার হার্টের রক্তনালিতে ব্লক পাওয়া গিয়েছিল। হার্ট ব্লক জাতীয় অসুস্থতা অনেক সময়ই বংশগত কারণে হয়ে থাকে। যদি তাই হয় তবে রিং-পরবর্তী সময়ে আবারও ব্লক সৃষ্টি হওয়ার একটু ঝুঁকিতে আছেন। যাদের হার্টে একবার ব্লক দেখা দিয়েছে পরবর্তীতে আবারও ব্লক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে যদি সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ, হৃদবান্ধব খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা মেনে চলেন তবে রিং-পরবর্তী সময় পুনরায় আপনার হার্টে ব্লক সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ কমে যাবে এবং আপনি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবেন। এখানে আরও কিছু বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ যেমন- আপনি যদি ডায়াবেটিক রোগী হয়ে থাকেন তবে পুনরায় ব্লক সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আপনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি, যদি না আপনার রক্তে সুগার কন্ট্রোলে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে যে কোনো উপায়েই হোক আপনাকে ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রাখতে হবে, হোক সেটা খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে অথবা খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক শ্রম সম্পাদনের মাধ্যমে অথবা এই দুইয়ের সঙ্গে মেডিসিন (মুখে খাওয়া ওষুধ/ইনসুলিন) গ্রহণ করে।
আপনার রক্তচাপ যদি বেশি থেকে থাকে তবে এক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে আপনার হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বুকের ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা বা অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবে অতিদ্রুত আপনার হার্ট ফেইলুর সৃষ্টি হতে পারে, যাতে আপনি অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠার পাশাপাশি শরীর ফুলে যাওয়া বা শরীরে পানি আসা মানে হাত, পা, পেট, মুখ পানিতে ফুলে যেতে পারে। তাই যে কোনো মূল্যে আপনার উচ্চ রক্তচাপকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
লেখক-
ডা. এম. শমশের আলী
সিনিয়র কনসালট্যান্ট (প্রা.)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।