ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও বিতর্কিত একটি নাম। প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করে, মানুষের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন। নিজের সম্পর্কে প্রচার খুব ভালোভাবে করেন ট্রাম্প। তাই পেয়েছেন সেলিব্রিটির মতো মনোযোগও। তবে সেই মনোযোগের সবটাই সুখের নয়। এরপরও পিছু হটেননি তিনি। উল্টো বলেছেন, দেশের জনগণ তার এই সাহসিকতার জন্য প্রশংসা করছে, কারণ তার ভাষায়, সমস্যাটিকে অনেকেই এড়িয়ে গেছেন। এর আগে বেশ কবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কখনোই শেষ পর্যন্ত দাঁড়ানো হয়নি। কিন্তু এবার একাবারে ক্ষমতার মসনদে বসার দ্বারপ্রান্তে তিনি। আগামীকাল ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে জিতলেই আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হবেন এই বিতর্কিত ব্যক্তি। কিন্তু ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন বিভিন্ন জরিপে এগিয়ে থাকায় সেই সম্ভাবনা অবশ্য কম। তারপরও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই কঠিন লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছেন ট্রাম্প। এবার চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক যেসব কারণে বিতর্কিত ট্রাম্প।
ইমিগ্র্যান্টবিরোধী
২০১৫ সালের ১৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থিতা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে তিনি নির্বাচনী স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (আমেরিকাকে আবার মহান করুন) প্রকাশ করেন। এই স্লোগানের পক্ষে বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে এবং নিচু মানের দেশ হয়ে গেছে। এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসীরা। ট্রাম্প বলেন, আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ক্ষমতার প্রথম দিনই আমেরিকায় অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের দ্রুত বের করে দেওয়ার জন্য কাজ করব। মেক্সিকান ইমিগ্র্যান্টরা আমেরিকায় ড্রাগস চোরাচালান করে, তারা বিভিন্ন অপরাধ করে, ধর্ষণ করে। ভালো মানুষ মেক্সিকো থেকে আসে না। যারা আসে তারা আনে হাজার সমস্যা। এই ঢালাও অভিযোগের পর ট্রাম্প বলেন, এটা বন্ধ করতেই হবে। সেটার জন্য আমি একটা গ্রেট ওয়াল বানাব। আমার চাইতে ভালো ওয়াল কেউ বানাতে পারে না। বিশ্বাস করুন, আমি খুব সস্তায় এই ওয়াল বানাব।
মুসলিমবিরোধী
ইমিগ্রেশন বিতর্কটি যখন ট্রাম্প শুরু করেন তখন তার মনে মুসলিম ইসুটা আসেনি। এটা আসে ২ ডিসেম্বর ২০১৫- তে ক্যালিফোর্নিয়ায় সান বারনারডিনো শহরে একটি উৎসবে মুসলিম দম্পতি, সৈয়দ রিজওয়ান ফারুক ও তাশফিন মালিকের অতর্কিত বন্দুক হামলায় ১৪ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটির পর। ফারুকের জন্ম হয়েছিল আমেরিকায় একটি পাকিস্তানি বংশে। তার স্ত্রী তাশফিনের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানে এবং তিনি ছিলেন আমেরিকান রেসিডেন্ট। তাদের ছয় মাস বয়সী শিশুকন্যাকে ফারুকের মার কাছে রেখে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলি চালান এবং নিজেরাও পাল্টা গুলিতে নিহত হন। এই দুর্ঘটনার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় ইসুটা আমেরিকানদের সামনে তুলে ধরেন। একটি লিখিত ভাষণ তিনি টিভিতে পড়ে শোনান, যার প্রথমেই ছিল নিচের লাইনগুলো : আমি ডোনাল্ড জন ট্রাম্প আহ্বান জানাচ্ছি। আমেরিকায় মুসলিমদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে। ট্রাম্প আরও বলেছেন, জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হওয়ার বিধানটি তুলে দিতে হবে। এর ফলে আমেরিকায় কোনো মুসলিম ইমিগ্রান্ট বা মুসলিম ট্যুরিস্টের আমেরিকায় জন্ম হওয়া সন্তানের আমেরিকান নাগরিকত্ব আর নাও পেতে পারেন।
সাদ্দাম-গাদ্দাফিতে নিরাপদ থাকত মধ্যপ্রাচ্য
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে বিশ্বজুড়ে ধিকৃত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গ তুলে নতুন বিতর্কে বনে যান ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে এবং লিবিয়াতে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ না করা হলে আজ মধ্যপ্রাচ্য অনেক নিরাপদ থাকত। তার মতে হিলারি ক্লিনটনের ভুল পররাষ্ট্র নীতির কারণে আজ মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার মানুষ মরেছে। লক্ষ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে শরণার্থী হয়ে দেশ বিদেশে ছুটছে। এবিসি নিউজের জনপ্রিয় একটি টিভি শোতে তিনি এসব কথা বলেন।
মনোনয়ন না দিলে দাঙ্গা
প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত না করলে যুক্তরাষ্ট্রে দাঙ্গা বাধবে বলে নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের হুঁশিয়ার করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মনোনয়ন দৌড়ে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান প্রতিনিধিদের ভোটে জয় পাওয়ার পর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন। নির্বাচনী প্রচারে ব্যবসায়ী ট্রাম্পের বিতর্কিত নানা বক্তব্যে ক্ষুব্ধ রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের মধ্য থেকেই তাকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন না করতে প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প সাক্ষাৎকারে বলেন, দলের বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধির সমর্থন নিশ্চিতের পরও যদি তাকে মনোনয়ন দেওয়া না হয়, তবে দাঙ্গা বাধবে। আমি মনে করি না, আপনারা ভাবছেন যে আমার জয় এমনি এমনি আসছে। আপনারা দাঙ্গা ডেকে আনবেন, দাঙ্গা ডেকে আনবেন। কেননা আমার পেছনে এখন লাখো মানুষ রয়েছে।’ যদিও শেষ পর্যন্ত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে রিপাবলিকানরা তাকেই বেছে নিয়েছে।
ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পোপের প্রশ্ন
মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ নিয়ে মন্তব্য করায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, পোপ ফ্রান্সিস। সে সময় মেক্সিকো সফরে গিয়ে পোপ বলেন, যে ব্যক্তি শুধু দেয়াল নির্মাণ করতে পারে কিন্তু সেতু নয়, সে খ্রিস্টান হতে পারে না। তবে পোপের এ মন্তব্যের পর নিজেকে গর্বিত খ্রিস্টান উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, পোপের এমন মন্তব্য অপমানজনক। ট্রাম্প ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ১১ মিলিয়ন মেক্সিকান নাগরিককে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে মেক্সিকানদের প্রবেশ ঠেকাতে টেক্সাস থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা দেন তিনি।
নিকৃষ্ট ব্যবসায়ী!
ব্যবসায়িকভাবে ট্রাম্প সফল হলেও তিনি খুবই বিতর্কিত ব্যক্তি। এমনকি ব্যবসায়ে তার সফলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাদের মতে, ট্রাম্প নিজে তার ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেননি, উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। আছে বিভিন্ন ক্রাইম সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ। তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমালোচকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ বৈধ উপায়ে তার এই বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া নিয়েই। তার বহু কোম্পানি ফেল করে অথবা দেউলিয়া হয়ে যায়। সমালোচকদের মতে, বিভিন্ন কোম্পানির নামে টাকা তুলে তিনি পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় এসব কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্যক্তিগত খাতে টাকা সরিয়ে নেন। আর এভাবেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এতে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে যেমন পথে বসানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের অন্ন কেড়ে নিয়েছেন। এই কারণেই তাকে অনেকেই নিকৃষ্ট ব্যবসায়ী বলেও সম্বোধন করেন। যদিও এসবের একটা উত্তর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, আমি দেশের প্রচলিত আইনের সুযোগ নিয়েছি। এটা ব্যবসা। অন্য ব্যবসায়ীরাও এটা করে থাকেন। মামলায় অন্য যে কোনো ব্যবসায়ীকে ছাড়িয়ে গেছেন ট্রাম্প। বিভিন্ন ব্যবসায়ে দেউলিয়াত্বের কারণে এবং আইনের মারপ্যাঁচে তার বিরুদ্ধে লোক ঠকানোর অভিযোগে আছে। এজন্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা শত শত মামলা ঠুকেছেন। সেসব মামলা এখনো চলছে। বড় বড় ব্যবসায়ীদের সাধারণত জনসেবায় এগিতে আসতে দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রেও ট্রাম্প ভিন্ন। অভিযোগ আছে, বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ট্রাম্প জনসেবায় মোটেই সময় ব্যয় করেননি। অথচ সেই ট্রাম্পই কিনা রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।
জঙ্গি নিধনের ওয়াটারবোডিং পদ্ধতি
এক সময় আল-কায়েদার কথা শোনা গেলেও বর্তমানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক এই সংগঠন এখন বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাধর দেশের মাথার কাটা। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ইতিমধ্যে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তারা। কোনো কিছুতেই তাদের দমন করা যাচ্ছে না। তবে ট্রাম্প মনে করেন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওয়াটারবোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। এই পদ্ধতিতে মুখের ওপর এমনভাবে পানি ঢালা হয় যে ওই ব্যক্তির মনে হবে তাকে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে আইএসকে বোমা মেরে দোজখে পাঠাবেন। তার মতে এবিষয়ে তার চেয়ে বেশি কঠোর আর কেউ হতে পারবেন না।
বিডি-প্রতিদিন/০৭ নভেম্বর, ২০১৬/মাহবুব