বিশ্বসেরা প্রভাবশালী ও খ্যাতনামা ৫০০ মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকা প্রকাশ করেছে ‘দ্য রয়েল ইসলামিক স্ট্যাটিজিক স্টাডিজ সেন্টার’ জর্ডানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন। সংগঠনটি প্রতি বছরের মতো এবারও ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ফাইভ হান্ড্রেড মোস্ট ইনফ্লুনশিয়াল মুসলিমস’ শিরোনামে তালিকা প্রকাশ করে।
জর্ডানের রাজধানী আম্মানে বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের আলোকে সংগঠনটি প্রথম ধাপে সর্বাধিক প্রভাবশালী ৫০ মুসলিম ব্যক্তির তালিকা নির্বাচন করে। এরপর চূড়ান্ত তালিকায় সেরা ১০ জন মুসলিম ব্যক্তির তালিকা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সেরা ১০ মুসলিম ব্যক্তিত্ব নির্বাচন করেছে সংগঠনটি। সে তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো :
আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি :
ইরানের সর্বোচ্চ (২য়)) ধর্মীয় নেতা সৈয়দ আলী হোসেনী খামেনেয়ী। ১৯৩৯ সালে জন্ম নেয়া সৈয়দ আলী হোসেনী খামেনিয়ী ইরানের ৮ কোটি শিয়া মুসলমানের আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ইরানের ৩য় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফোর্বস সাময়িকী ২০১২ সালে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ২১ জনের মধ্যে স্থান দেয়। আর গত বছর এ সংগঠনটির তালিকা তিনি ছিলেন চতুর্থতম ব্যক্তিত্ব। ১৯৮১ সালের জুন মাসে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সে হামলায় তিনি বেঁচে গেলেও তার ডান হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। তিনিই পারমানবিক অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ বলেন। ৮০ বছর বয়সী এ ধর্মীয় নেতা রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষমতার কারণে এবার দ্বিতীয় তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অন্যতম সমর্থকও খামেনি।
রিসেপ তায়িফ এরদোয়ান :
তুরস্কের ১২তম রাষ্ট্রপতি রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান। ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয়া কুরআনে হাফেজ এ রাষ্ট্রপতি ২০১৪ সাল থেকে দেশটির প্রধান হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। ২০০১ সালে তিনি একে পার্টি (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি বা একেপি) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই দলটি জনসমর্থনের মাধ্যমে এক নম্বর অবস্থানে চলে আসেন। পর পর ৪ বার সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী এরদোয়ান রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে দলটির সভাপতি ও প্রধান দলনেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।এরদোয়ান ২০০৩-২০১৪ পর্যন্ত তুরষ্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ১৯৯৪-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই ২০০৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকার শীর্ষে ছিলেন। তবে চলতি বছরের জরিপে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন তিনি।
সালমান বিন আবদুল আজিজ :
দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম এবং আল সৌদের প্রধান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। তিনি ২০১৫ সালে তার সৎভাই বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেয়া বাদশাহ সালমান ২০১১ সালে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রিয়াদ প্রদেশের গভর্ণর ছিলেন। তিনি বর্তমানে প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বদের তালিকায় চতুর্থ স্থান দখল করেন। ৮৪ বছরের বাদশাহ সালমান পবিত্র কাবা শরিফেরও প্রধান। ২০১৬ ও ২০১৭-তে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন ও ২০১৮ তে ২য় অবস্থানে ছিলেন।
মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান :
আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স সংযুক্ত আরব আমিরাতের সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি সুপ্রিম কমান্ডার ৫৮ বছর বয়সী শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। তিনি প্রয়াত শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের তৃতীয় ছেলে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বজন-সম্মানিত প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি একাত্তরে স্বাধীনতা থেকে ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দানশীলতা, দাতব্য ও উন্নয়নের কারণে তাকে এ তালিকায় মনোনিত হয়েছেন। ১০ জন ব্যক্তির তালিকায় তিনি তৃতীয় স্থানে রয়েছেন।
মুফতি মুহম্মদ তাকি উসমানি :
বিচারপতি মাওলানা মুফতি মুহম্মদ তকি উসমানি। ১৯৪৩ সালে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের একজন প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব। তিনি ইলমে হাদিস, ফিকহ, তাসাউফ ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ আদালতের এবং ১৯৮২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়াহ আপিল বেঞ্চের বিচারক ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘মাআরিফুল কুরআন’-এর রচয়িতা মুফতি শফি উসমানি তার বাবা। এবারের তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা মুফতি তকি ওসমানি গত বছর ৬ষ্ঠ স্থান অর্জন করেছিলেন। ৭৫ বছর বয়সী বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব উর্দু, বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় তার অনেক গ্রন্থ ও গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে।
কিং আবদুল্লাহ ইবনে আল হুসাইন :
জর্ডানের বর্তমান বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসাইন। ১৯৬২ সালে জন্ম নেয়া আব্দুল্লাহ তার পিতার মৃত্যুর পর ১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। হাশিমি রাজপরিবারের সদস্য তিনি। ১৯২১ সাল থেকে হাশিমি পরিবার জর্ডান শাসন করে আসছে। তাদেরকে হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলা হয়। বাদশাহ হুসাইন ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী মুনা আল-হুসাইনের সন্তান হলেন বাদশাহ আবদুল্লাহ। বাদশাহ আব্দুল্লাহ ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রানিয়া আল-আবদুল্লাহকে বিয়ে করেছেন। বাদশাহ আব্দুল্লাহ ১৯৯৩ সালে জর্ডানের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ড গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৮ সালের মে মাসে মেজর জেনারেল হন। দুবাইয়ের আমির মুহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাখতুমের স্ত্রী হায়া বিনতে হুসাইন বাদশাহ আবদুল্লাহর বোন। বাদশাহ আব্দুল্লাহ এই তালিকার পঞ্চম স্থানে রয়েছেন। তিনি ২০১৭ ও ২০১৬ এর তালিকায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি তৃতীয় হয়েছিলেন। ৫৪ বছর বয়সী জর্ডানের এ বাদশাহ রাজনীতি ও ঐতিহ্যবাহী বংশের বিবেচনায় তালিকায় স্থান পেয়েছেন। রাজত্বের পাশাপাশি বর্তমানে তিনি পার্শ্ববর্তী জেরুজালেমের বিভিন্ন অঞ্চলের দেখভালের দায়িত্বেও রয়েছেন।
সুলতান কাবুস বিন সাদ-আল-সাইদ :
ওমানের বর্তমান সুলতান কাবুস বিন সাদ ১৯৪০ সালে জন্ম নেয়া সুলতান কাবুস তার বাবা সাইদ বিন তাইমুরকে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যেমে ক্ষমতাচ্যুত করে ওমানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি আল-সাইদ রাজবংশের ১৪তম প্রজন্ম। তিনি সুলতান সাইদ বিন তাইমুর ও শাইখা মাজনুন আল-মাশানির একমাত্র পুত্র ছিলেন। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সালালাহ ও ভারতের পুনেতে লাভ করেছেন। পুনেতে তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার ছাত্র ছিলেন। ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষে ২০ বছর বয়সে তিনি রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে যোগ দেন। স্যান্ডহার্স্ট থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি জার্মানিতে একবছর দায়িত্বপালন করেছেন। ১০ স্থানে থাকা ৭৮ বছর বয়সী সুলতান কাবুস বিন সাদ-আল-সাইদ সামাজিক ও পোলিটিক্যালি সক্রিয় রাজা। গত ৪৯ বছর ধরে তিনি ওমানে রাজত্ব করেছেন। সুলতান কাবুস ওমানকে আধুনিকায়ন করেছেন।
কিং মুহাম্মাদ ষষ্ঠ :
মরক্কোর বর্তমান বাদশাহ (৬ষ্ঠ) মোহাম্মদ। ১৯৯৯ সালে মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হোসাইনের মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯৬৩ সালে জন্ম নেয়া মরক্কোর রাজা কিং মুহাম্মদ তালিকার সপ্তম স্থানে রয়েছেন। গত দুই বছরও তিনি একই স্থানে ছিলেন। ৫৬ বছর বয়সী এ রাজা রাজনীতি, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দেশীয় সার্বিক উন্নয়নের বিবেচনায় প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
তিনিও পারিবারিকভাবে সরাসরি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর। গত ৪০০ বছর ধরে কিং মুহাম্মদের পূর্বপুরুষরা মরোক্কো শাসন করে আসছেন।
সাইয়েদ আলী হুসাইন সিস্তানি :
তালিকার অষ্টম স্থানে থাকা সাইয়েদ আলী হুসাইন সিস্তানি ইরানের অন্যতম প্রভাবশালী শিয়া নেতা। ১৯৩০ সালে জন্ম নেয়া এ প্রবীণ প্রভাবশালী শিয়া ব্যক্তিত্ব শিক্ষাজ্ঞান ও বংশক্রমের বিবেচনায় এবারো শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ৮৯ বছরের সাইয়েদ আলী হুসাইন সিস্তানি ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও তিনি সপ্তম স্থানে ছিলেন। তবে ২০১৬ সালে তিনি সেরা দশের বাইরে ছিলেন। ইরানের প্রভাবশালী এ ধর্মীয় নেতা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৫ ও ২০১৪ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য বাছাই তালিকায় মনোনীত হয়েছিলেন।
শায়খ হাবিব উমর বিন হাফিজ :
ইয়েমেনের ‘দারুল মুস্তাফা সংস্থা’র পরিচালক শায়খ হাবিব উমর বিন হাফিজ শীর্ষ নবম স্থানে রয়েছেন। ৫৬ বছর বয়সী এ প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্ব গত বছর অষ্টম স্থানে ছিলেন। ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণকারী উমর বিন হাফিজ বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীভিত্তিক বিভিন্ন রচনাকর্মের জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিত। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার, শিক্ষক ও পরিচালক উমর বিন হাফিজ আবুধাবির তাবাহ ফাউন্ডেশনের সুপ্রিম অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক