৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ১২:০৪

রাজাকারদের মদতে ১৯৭১-এ গণহত্যাই ছিল পাক-সেনার প্রধান লক্ষ্য

অনলাইন ডেস্ক

রাজাকারদের মদতে ১৯৭১-এ গণহত্যাই ছিল পাক-সেনার প্রধান লক্ষ্য

ফাইল ছবি

গণহত্যাই ছিল পাক-সেনার প্রধান লক্ষ্য। নিজের কানে শুনেছেন সেকথা। তারপর বিশ্ববাসীর কাছে ১৯৭১-এ গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক আন্থনি মাসকারেনহাস। 

তার প্রতিবেদন পড়েই ইন্দিরা গান্ধি থেকে শুরু করে গােটা দুনিয়া আঁচ পান পাকিস্তানি বর্বরতার। বাস্তবে অবশ্য পাক-বর্বরতা ছিলো আরও ভয়ঙ্কর। ৩০ লাখ মানুষকে খুন বা ৩ লাখেরও বেশি নারীকে ধষণের শিকার হতে হয় পাক-সেনার মানবতা বিরােধী অভিযানে। সেইসব গোপন করে সেনাবাহিনীর জয়গান গাইতেই নিয়ে আসা হয়েছিল অ্যান্থনিদের। বাকিরা নিরব থাকলেও অ্যান্থনি তুলে ধরেছিলেন আসল ঘটনা। আদর্শ সাংবাদিকতার মূর্ত প্রতিক অ্যান্থনিকে নিয়েই বিবিসি প্রকাশ করেছে বিশেষ প্রতিবেদন। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক ডামমেট কথা বলেছেন অ্যান্থনির স্ত্রী ইভন মাসকারেহানসের সঙ্গেও।

১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের সানডে টাইমস-এ প্রতিবেদনের হেডলাইন্স ছিল জেনোসাইড। আর বিবিসি বলছে এই প্রতিবেদনই ইতিহাস পরিবর্তনের বড় ভূমিকা নেয়। মাত্র ২৪ বছরের তরুণ আবদুল বারিকে পাক-সেনা যেভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রকৃত বিবরণ ছবির মতাে উঠে আসে অ্যান্থনির কলামে। উঠে আসে আরও বহু। গণহত্যা ও পাক-সেনা বর্বরতার গ্রাউন্ড রিপোর্টিং। সানডে টাআমস-এ প্রকাশি জেনোসাইডকেই বিবিসি বলছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিকতার নিদর্শন। ১৯৭১-এ। পাকিস্তান সেনা নিষ্ঠুরতার ছবি গােটা দুনিয়া এই প্রতিবেদন থেকেই জানতে পারেন। এই প্রতিবেদনই বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনকে তরান্বিত করতে সাহায্য করে।

বিবিসি-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাক-সেনার আক্রমণে যে লাখ লাখ মানুষ খুন হয়েছেন বা নারী-শিশুরা ধর্ষিতা হচ্ছেন, এটা গােটা দুনিয়ারই জানা ছিলােনা। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন। অথচ বিশ্ববাসী বিষয়টি জানতেই পারেনি। বন্দুকের নল দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে শায়েস্তা করে চেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু সেই কৌশল শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কারণ ভারতের সার্বিক সহযােগিতায় আর মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মত্যাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের দক্ষতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

পাকিস্তানে অ্যান্থনিকে সাংবাদিক হিসাবে সকলেই বেশ শ্রদ্ধা করতেন। ৭১-এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর আগে বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বার করে দিয়েছিল পাক-সেনা। আর নিজেদের ঢাক পেটানাের জন্য করাচি থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল জনা আটেক সাংবাদিককে। তাঁদের বলা হয়েছিল, সেনাকর্তারা যা বলবেন তাই লিখতে হবে। সামরিক শাসনে এর বেশি কিছু লেখার ক্ষমতাও তাদের ছিলো না। তাই পাকসাংবাদিক দলের সামনেই চলে গণহত্যা। বহু ঘটনারই স্বাক্ষী তারা। কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে সেনা বাহিনীর শিখিয়ে দেওয়া কথাই প্রকাশিত হতে থাকে পাকিস্তানি গণমাধ্যমে। ৮ সাংবাদিকের মধ্যে ৭ জনই ছিলেন সেনাকর্তাদের বিশ্বস্ত। ব্যতিক্রম একজন। একটি শব্দও লিখতে পারেননি অ্যান্থনি। কারণ তিনি জানতেন, ঘটনার বিবরণ লিখলেই তাঁর পক্ষে পাকিস্তানে বেঁচে থাকা অসম্ভব হবে। লন্ডনবে বসে বিবিসি-র কাছে ইভনের স্ত্রী বলেন, 'আমি অ্যান্থনিকে এতােটা ভেঙে পড়তে দেখিনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে সে এতােটাই আবেগপ্রবণ হয়েছিল, আমি বোঝাতে পারবােনা। প্রচন্ড শােক আর হতাশায় ভুগছিল। বলেছিল, গণহত্যার কথা লিখতে না পারলে আমার হাত দিয়ে কোনও লেখাই আর বার হবেনা।

বােনের বাড়ি যাওয়ার নাম করে অ্যান্থনি পাকিস্তানি বর্বরতার স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে উড়ে যান লন্ডন। সেখানে গিয়ে তিনি সরাসরি দ্য সানডে টাইমস-এর এডিটর ইভনের সঙ্গে দেখা করেন। বর্ণনা করেন পাক-বাহিনীর বর্বরতার। গণহত্যার রােহর্ষক বিবরণ তুলে ধরেন অ্যান্থনি। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পরিবারেপ সকলে লন্ডনে উড়িয়ে আনার প্রস্তাব দেন ইভন। সেইমতো সকলে লন্ডন পৌঁছালে প্রকাশিত হয় জেনােসাইড। এই একটি প্রতিবেদনই গােটা বিশ্ব শিহরিত হয়ে ওঠে। ধরা পড়ে যায় আল-বদর ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাক সেনার গণহত্যার ছবি। উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণহত্যা ও বর্বরতায় পাক-সেনার নিষ্ঠুরতার কথা। অ্যান্থনির সামনে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়েছে ঠান্ডা মাথায়। অগণিত মা-বােনের আর্তনাদ ফুটে ওঠে সেই প্রতিবেদনে। একজন পাকিস্তানি নাগরিকের কলামেই উঠে আসে বর্বরতার প্রকৃত বিবরণ। সেইসঙ্গে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বও ধরা পড়ে জেনােসাইড-এ।

সানডে টাইমস-এর এডিটর ইভান তাঁর স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন অ্যান্থনির কাছ থেকে শােনা বাংলাদেশে পাক-গণহত্যার বহু অপ্রকাশিত নিষ্ঠুরতার কথা। অ্যান্থনি সেই ঘটনাগুলগুলি তাঁকে বলেছিলেন। ঘর বন্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নিরীহ গ্রামবাসীদের। আবার লাই দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়েছে অগণিত মানুষকে। নারী-শিশু কেউই বাদ যাননি পাক-বর্বরতার হাত থেকে। পাক-সেনাদের স্থানীয় এজেন্টরা ইচ্ছে মতাে মানুষ খুনে মদত দিয়ে গিয়েছে। ইভানের কথায়, অ্যান্থনি গণহত্যা চলাকালে বহুবার শুনেছে সেনা কর্তারা বলছেন, বন্দুকের নলই নাকি মেটাতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা। গণহত্যাই নাকি মুক্তিযােদ্ধাদের বাগে আনার একমাত্র পথ। তাই গণহত্যা চলতেই থাকে।
অ্যান্থনির স্ত্রী ইভনের এখনও মনে আছে দেশ ছাড়ার স্মৃতি। স্বামীর টেলিগ্রাম পেয়েই সন্তানদের নিয়ে আফগানিস্তান হয়ে উড়ে আসেন লন্ডন। সেখানে নতুন করে জীবন যাত্রা শুরু। কিন্তু সবসময়ই তাঁর মধ্যে আতঙ্ক কাজ করতো। এমনকী, লন্ডনের বহু মানুষ তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখতেন। অনেকে মনে করতে তাঁর স্বামী অন্য দেশের চর। কিন্তু ইভন নিশ্চিত, সততার সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি অ্যান্থনি। চিরকালই ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই পাকিস্তানিদের বর্বরতায় আর ৭ জন সাংবাদিকের মতো তিনিও তােতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওরাতে পারনেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ করেছেন বর্বরতার ধারাবিবরণী। সততার সঙ্গে তুলে ধরেছেন অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতার কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আতিথেয়তায় থেকেও নিদের আদর্শের সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি অ্যান্থনি। ইভােনার কথায়, বরং সেনাকর্তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ছলনায় তুলে এনেছেন গণহত্যার প্রকৃত রূপ। পাকিস্তানি দালালদের অনেকেই অ্যান্থনিকে বিশ্বাসঘাতক বলেও বর্ণা করে থাকেন। মানতে নারাজ ইভন। তাঁর মতে নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই অ্যান্থনিকে এটা করতে হয়েছিল। চোখের সামনে নিরীহমানুষের ওপর নৃশংস অত্যাচার নিরবে মেনে নেওয়ার মতো ক্ষমতা তার ছিলো না। তাই তিনি প্রকাশ করেছেন দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম গণহত্যার বিবরণ।

পাকিস্তানের নাগরিকদেরও একটা অংশ কিন্তু অ্যান্থনির ভূমিকাকে সমর্থন করেছিলেন। লন্ডনে বসবাস করার সময়ও তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল পাকিস্তানের অনেকেই। তাই তাে তিনি লন্ডনে বসেই পাকিস্তানি পারমানবিক শক্তি নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সক্ষম হন।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর