প্রতিদিন অফিস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন বেসরকারি চাকরিজীবী আহমেদ শাকিল। চায়ের কাপ ঘিরে জমে উঠত সাহিত্য, রাজনীতি, ক্রিকেট, সিনেমা ও জীবনের নানা গল্প। প্রতিদিন অন্তত চার কাপ খেতেন। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র দুই কাপে। শাকিল বলেন, ‘একসময় ২০-২৪ টাকায় চার কাপ চা খেতাম। এখন ৩০ টাকায় হয় মাত্র দুই কাপ। বেতন বাড়েনি, কিন্তু খরচ বেড়েছে। বাধ্য হয়ে চা-আড্ডাও কমিয়ে দিতে হয়েছে।’
চায়ের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়ীদের ওপরও। কারওয়ান বাজারের চা বিক্রেতা নুরুল আলম জানান, ১৫ বছর আগে দুধ চা ৩ টাকায় আর রং চা ২ টাকায় বিক্রি করতেন তিনি। এখন দুধ চা বিক্রি করেন ১৫ টাকায় এবং রং চা ১০ টাকায়। ‘চা পাতার দাম বেড়েছে, দুধ-চিনির দামও ঊর্ধ্বমুখী। আগে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি চা পাতা কিনতাম, এখন তা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ফলে বাধ্য হয়ে দাম বাড়াতে হচ্ছে,’ -বলেন নুরুল।
রোজকার খরচের চাপে ভোক্তাদের ওপরও পড়েছে প্রভাব। রিকশাচালক সুমন মিয়া বলেন, ‘আগে ১০ টাকায় চা-বিস্কুট দুটোই পাওয়া যেত, এখন শুধু চা-ই ১২ টাকা। তাই আগের মতো চা খাওয়া হয় না।’ কেন বাড়ছে চায়ের দাম? চায়ের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, চা পাতা, দুধ, চিনি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন ব্যয়, এমনকি প্লাস্টিক কাপ ও চামচের মূল্যও বেড়েছে। ফলে দোকান পরিচালনার সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে গেছে। মগবাজারের চা বিক্রেতা মো. জয়নাল বলেন, ‘প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ে। আমাদেরও তো বেশি দামে কিনতে হয়, তাই চায়ের দাম না বাড়িয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু এতে খদ্দের কমে যাচ্ছে।’ এদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা বাড়লেও উৎপাদনে এসেছে ভাটা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে চা উৎপাদন হয়েছিল ১০ কোটি ২ লাখ কেজি, আর ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজিতে। চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, শ্রমিক মজুরি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাগান মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়ছিলেন। তাই উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি, এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে খুব একটা পড়বে না।’ তবে ন্যূনতম দর বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকেই খোলা বাজারে চায়ের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা।
সংকটে চা শিল্প : চায়ের চাহিদা বাড়লেও শিল্পটি রয়েছে নানা সংকটে। উৎপাদন ব্যয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চায়ের দাম বাড়ছে। যদিও চা বোর্ড বলছে, উৎপাদন কিছুটা কমলেও বাজারে সরবরাহে তেমন প্রভাব পড়েনি।
চা শিল্পের এ চিত্র দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চায়ের কাপে ভেসে থাকা গল্পগুলো যেন আজ ম্লান হয়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপে।