সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘিরে গড়ে উঠেছে অসাধু অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। এ চক্রের বাইরে কেউ রোগী বা তাদের স্বজনদের আনা-নেওয়া করতে পারবেন না। হাসপাতাল থেকে কেউ রোগী বা লাশ নিয়ে গন্তব্যে যেতে চাইলে সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হচ্ছে। সবাই একই ভাড়া হাঁকাচ্ছে। ওই ভাড়ার নিচে কেউ যেতে চাইলে তার ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসছে। বাইরের অ্যাম্বুলেন্স তো প্রশ্নই আসে না। এভাবেই প্রতিটি হাসপাতালে আধিপত্য বিস্তার করেছে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নানা দুর্ঘটনাসহ মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ছে অনেকে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুর পৌরসভার চৌরঙ্গির মোড়ে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীর স্বজনরা নামতেই ঘিরে ধরে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। লাগামহীন ভাড়া শুনে অনেক স্বজন হতবাক হয়ে পড়ে। মেলাতে পারে না ভাড়ার হিসাব। সাধারণত এসব হাসপাতালে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। অনেকের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে হাত খালি হয়ে যায়। হাসপাতালগুলোতে কখনো জীবনের জয়গান আবার কখনো স্বজন হারানোর আহাজারি যেন নিত্যদিনের গল্প। এ সিন্ডিকেটের গাড়ি ছাড়া গন্তব্যে যাওয়ার বিকল্প নেই। বাহির থেকে যেসব অ্যাম্বুলেন্স আসছে সেগুলো ফিরতি ট্রিপ ধরা তাদের জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ফলে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটে বন্দি থাকছে সাধারণ মানুষ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্স চালক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় অসুস্থ অবস্থায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শরীয়তপুরের অ্যাম্বুলেন্স চালক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার কারণেই এ মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে। রোগীর স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর এলাকার নূর হোসেন সরদারের স্ত্রী রুমা বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে স্বজনরা তাকে জেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তবে বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অসুস্থ বোধ করায় চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা যাওয়ার জন্য ঢাকাগামী একটি অ্যাম্বুলেন্স ৫ হাজার টাকায় ভাড়া করেন।
পরবর্তীতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে গাড়িটির গতিরোধ করে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স চালক সবুজ দেওয়ান ও আবু তাহের দেওয়ান নামে দুই ব্যক্তি। তাদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় যেতে দেওয়া হবে না। একপর্যায়ে তারা ঢাকাগামী সেই অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি কেড়ে নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে। এ সময় রোগীর স্বজনরা বাধা দিলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। এমন অবস্থায় দীর্ঘ ৪০ মিনিট অ্যাম্বুলেন্স আটক থাকার পর শিশুটি সেখানেই মারা যায়। এমন ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা।
নবজাতকের নানি শেফালী বেগম বলেন, ‘আমার নাতিকে ঢাকায় নিতে পারলে হয়তো বেঁচে যেত। ওরা আমার নাতিকে বাঁচতে দেয়নি। ওদের জোরাজুরিতে আমার নাতির মুখ থেকে অক্সিজেন খুলে গেছে। ওদের আমি বিচার চাই। আমরা গরিব মানুষ। ওরা ১০ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া চেয়েছিল। এত টাকা আমাদের ছিল না। তাই ৫ হাজার টাকায় ঢাকার একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছিলাম। কিন্তু ওরা আমার নাতিকে বাঁচতে দিল না। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
এ ব্যাপারে পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে মেট্রো ক্লিনিকে ওই শিশুর জন্ম হয়। তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চিকিৎসক দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা অবগত হয়েছি। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমরা অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।