ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসা শিল্পীরা মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকদের। পরিণত হয়েছিলেন তারকায়। কমপক্ষে ২০০০ সালের প্রথম পর্যন্ত বড় পর্দা দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাঁরা। এসব তারকার অনেকেই এ ধরাধামে এখন নেই। যারা আছেন তাঁরা কেমন আছেন। সেই কথাই তুলে ধরেছেন-আলাউদ্দীন মাজিদ
শবনম
পুরান ঢাকার নারিন্দার মেয়ে নন্দিতা বসাক ঝর্ণা। ১৯৫৯ সালে চলচ্চিত্রকার এহতেশাম কিশোরী শিল্পী হিসেবে তাঁকে ‘এদেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে ব্রেক দেন। এরপর আরও পাঁচটি চলচ্চিত্রে কিশোরী শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৬১ সালে এহতেশাম প্রযোজনা করেন ‘হারানো দিন’। এহতেশামের ভাই আরেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা এ ছবিটি পরিচালনা করেন। এতে এহতেশামের দেওয়া নাম ‘শবনম’ পরিচয়ে অভিনয় শুরু করেন ঝর্ণা। নায়িকা হিসেবে এহতেশাম পরিচালিত ‘চান্দা’ (১৯৬২) ঢালিউডে শবনমের স্থায়ী আসন গড়ে দেয়। ১৯৯৯ সালে শবনম সর্বশেষ অভিনয় করেন কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে। বর্তমানে তিনি ধর্মকর্ম আর সংসারের কাজ নিয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছেন রাজধানীর বারিধারার বাসায়।
আনোয়ারা
১৯৬১ সালে ১৪-১৫ বছর বয়সে অভিনেতা আজিমের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসা অভিনেত্রী আনোয়ারা ২০০০ সালের প্রথম পর্যন্ত অভিনয়ে সক্রিয় ছিলেন। এ অভিনেত্রীর সর্বশেষ ২০১৯ সালে অভিনীত ও মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হচ্ছে- ‘মা’। ২০২২ সালের দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও অভিনয়ে আর ফেরার মতো অবস্থা তাঁর নেই। এখন মেয়ে মুক্তির সঙ্গে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান। এ ছাড়া নামাজ-রোজায় কাটে তাঁর দিন।
শাবানা
১৯৬৭ সালে ১৪ বছর বয়সে এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরী’তে শাবানা নাম ধারণ করে নায়িকা হন তিনি। এ নামটি তাঁকে এহতেশামই দিয়েছেন। এ চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হলে শুরু হয় নায়িকা শাবানার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। শাবানা সর্বশেষ অভিনয় করেন ১৯৯৯ সালে প্রয়াত চিত্রনির্মাতা আজিজুর রহমানের ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ চলচ্চিত্রে। নব্বই দশকের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হন তিনি। মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রেই কাটছে তাঁর প্রবাস জীবন। সেখানে স্বামী, সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ ভালো সময় কাটছে তাঁর। ঘরের কাজ, নামাজ-রোজা আর টিভি দেখা ও বই পড়তেই এখন আনন্দ তাঁর বলে জানান ঢাকাই চলচ্চিত্রের এ বিউটিকুইন।
সুচন্দা
ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে আসা কিংবদন্তি অভিনেত্রী ‘বেহুলা’ ছবি খ্যাত সুচন্দা। নব্বই দশকের শেষ ভাগে অভিনয় ছাড়েন তিনি। এখন বনানীতে পুত্র-কন্যা আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গেই সময় কাটান। সময় পেলেই চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে ভাইদের কাছে বেড়াতে। সন্তান, নাতি-নাতনি আর বোন ববিতা ও চম্পাকে নিয়ে গল্প করে সময় কেটে যায় বলে জানান তিনি। বাসায় নামাজ-রোজা আর ঘরের কাজ নিয়েই ব্যস্ততা তাঁর। এ ছাড়া বই পড়েন, টিভি দেখেন, এভাবেই কেটে যায় কিংবদন্তি এ অভিনেত্রীর সময়।
ববিতা
সত্তর দশকে চলচ্চিত্রে আসা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা সর্বশেষ অভিনয় করেন ২০১৫ সালে ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবিতে। এরপর মানসম্মত গল্পের অভাবে তিনি অভিনয় থেকে দূরে সরেন। ঘরের কাজ, কানাডায় পুত্র অনীক এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভাইদের কাছে সময় পেলেই ছুটে যান। ইউটিউবে পুরোনো দিনের সিনেমা দেখেন। অন্যান্য কাজের ফাঁকে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ডিসিআইআই-এর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বব্যাপী অসহায় শিশুদের কল্যাণেও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
রোজিনা
সত্তর দশকে ‘জানোয়ার’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আসা জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজিনা ২০০০ সালের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ২০০৫ সালে আবার দেশে ফিরে প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মতিন রহমানের ‘রাক্ষুসী’ ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর কিছু টিভি নাটকে অভিনয় ও নাটক নির্মাণ করেন তিনি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আসা-যাওয়া চলতে থাকে। বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে দেশেই আছেন তিনি এবং প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনাও করছেন। ২০২১ সালে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এ ছবির শিরোনাম ‘ফিরে দেখা’। ছবিটিতে অভিনয়ও করছেন রোজিনা। তা ছাড়া তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এখন কখনো ঢাকা আবার কখনো রাজবাড়ীতে ঘুরেবেড়িয়ে সময় কাটে এ জনপ্রিয় অভিনেত্রীর।
সোহেল রানা
স্বাধীন দেশে প্রথম মুক্তযুদ্ধভিত্তিক ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক মাসুদ পারভেজ। সত্তর দশকে ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সোহেল রানা নামে অভিনয়ে আসেন। দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় থেকে দূরে আছেন তিনি। বাসায় টিভি দেখা, বই পড়া, নামাজ-রোজা পালনসহ চলচ্চিত্র জগতের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন তিনি। প্রায়ই গণমাধ্যমের মুখোমুখিও হন। এ কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের কথায়- ‘আমি প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করে আসছি। সিনেমা প্রযোজনা, পরিচালনা, অভিনয়সহ রাজনীতি সব মিলিয়ে জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যস্ত থেকেছি। এখন বয়স হয়েছে। শরীরের যেমন সীমা আছে তেমনি মনেরও ক্লান্তি আছে। এ বয়সে এসে মনে হচ্ছে এখন থামার সময়। তাই থামলাম।’
আলমগীর
১৯৭৩ সালে আলমগীর কুমকুমের পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয়ে আসেন আলমগীর। সহজেই দর্শকপ্রিয়তা পান। অভিনয় করেছেন প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে। এ ছাড়া প্রযোজনা এবং পরিচালনাও করেছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে অভিনয় ও নির্মাণ থেকে দূরে আছেন তিনি। এখন নিজের বায়িং হাউস ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দেখাশোনা এবং পরিবারের সঙ্গেই সময় কেটে যাচ্ছে তাঁর।
অঞ্জু ঘোষ
১৯৮২ সালে ফোক ফ্যান্টাসি এবং রোমান্টিক ছবির নির্মাতা এফ কবির চৌধুরী ‘সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে অঞ্জু ঘোষকে অভিনয়ে ব্রেক দেন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করে যান। থাকেন কলকাতার সল্ট লেক এলাকায়। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমের কাছে তিনি জানান, ‘আমার বাড়িতে মন্দির রয়েছে, ধর্মকর্ম, পূজা-পার্বণ করেই সময় কেটে যায়। ঘরের কাজকর্ম নিজেই করতে পছন্দ করেন। টেলিভিশনে খবর দেখেন, তবে টিভি সিরিয়াল দেখা তিনি পছন্দ করেন না। অবসর সময়টা ভাগ করে নেন নিজের ভাইয়ের বাচ্চাদের সঙ্গে।
সুচরিতা
১৯৭৬ সালে গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রযোজিত ও দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘সমাধি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়িকা হন সুচরিতা। এর আগে ‘বেবী হেলেন’ নামে সিনেমায় শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। আশির দশকের শেষদিকে সংসারের কারণে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরেন তিনি। আবার ২০০০ সালে অভিনয়ে ফিরে আসেন। অভিনয় করেন মা, ভাবির চরিত্রে। এখন ঘর সংসার নিয়েই তাঁর সময় কাটে বলে জানান তিনি।
অলিভিয়া
১৯৭২ সালে ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ছবিতে অলিভিয়া নায়িকা হয়ে এলেন। ৫৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এ জননন্দিত অভিনেত্রী। প্রথম স্বামী চিত্রপরিচালক এস এম শফির মৃত্যুর পর চলচ্চিত্র ত্যাগ করেন অলিভিয়া। বিয়ে করেন ফতুল্লার মুনলাইট টেক্সটাইল মিলের কর্ণধার হাসানকে। বর্তমানে বসবাস করছেন বনানীর ডিওএইচএসের বাড়িতে। ধর্ম-কর্ম পালন ও সংসার নিয়েই পরম সুখে কাটছে তাঁর জীবন।