আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ভূমিকা ও গুরুত্ব কারো অজানা নয়। বর্তমান সময়ে খেলাধুলা হচ্ছে একটি বড় ধরনের সংবাদ যৌগ। ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকরা হলেন ক্রীড়াঙ্গনের চোখ, মানুষের শব্দ ও কণ্ঠস্বর। খেলাধুলা এখন আলাদা একটা বর্ণিল জগৎ। এই জগতের সংস্কৃতি ও আবেদন পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। ক্রীড়া লেখনী ও ক্রীড়াচর্চা উভয়ের প্রয়োজনে উভয়। ক্রীড়াচর্চা আর ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুধু চ্যালেঞ্জে ভরপুর নয়, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীলও বটে। এখানে ‘মনোটোন’ নেই, তবে দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীল আচরণ অনেক বেশি।
এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ জবাবদিহি পদে পদে। ক্রীড়া সাংবাদিকতা পেশার আরেকটি বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত শেখা ও অভিজ্ঞতা অর্জন। ২ জুলাই বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবস। ১৯২৪ সালের ২ জুলাই এআইপিএসের (ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন) জন্ম ফ্রান্সে।
সাংবাদিক ও ক্রীড়া লেখকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একমাত্র সংস্থা এআইপিএসের ১০১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৯৫ সাল থেকে এআইপিএসের বিশ্বজুড়ে ‘অ্যাফিলিয়েটেড’ সংস্থাগুলো দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবস পালন করছে। বাংলাদেশে এর স্বীকৃত সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, বর্তমানে যেটি বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি (বিএসপিএ) বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবসে দেশের খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকদের সম্মাননা দিয়েছে এবং এই কর্মসূচিতে কখনো ছেদ পড়েনি। প্রথমবার (১৯৯৫) সম্মাননা পেয়েছেন এ বি এম মূসা ও সৈয়দ জাফর আলী।
ষাটের দশকে সাবেক চৌকস ক্রিকেটার, ক্রিকেট লেখক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার, কূটনীতিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান আতিকুজ্জামান খানকে সভাপতি করে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন। আতিকুজ্জামান খানের সঙ্গে অন্য যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন আনিসুল মওলা, গজনফর আলী, এ বি এম মূসা, আওয়াল খান, কামাল লোহানী, মিজানুর রহমান, এম এ মান্নান, আবদুল হামিদ, হাসান সাঈদ, তৌফিক আজিজ খান, জে ডেভিডসন প্রমুখ। এই অ্যাসোসিয়েশন সেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচন করার মাধ্যমে পুরস্কার প্রবর্তন করে। ১৯৬৪ সালে প্রথম বছর পুরস্কার পেয়েছেন খ্যাতিমান ফুটবলার জহিরুল হক। এরপর ১৯৬৬ সালে পুরস্কার পান ফুটবল ও হকিতে অনন্য কৃতিত্বের জন্য ক্রীড়াবিদ বশির আহমেদ।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা বাঙালিদের জন্য সর্বক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। অবসান হয়েছে শোষিত ও বঞ্চিত হওয়ার দিনগুলো। সুযোগ এসেছে নিজেদের ক্রীড়াঙ্গন গড়ে তোলার। পাল্টে গেছে ক্রীড়াঙ্গনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট। স্বাভাবিকভাবেই ক্রীড়া সাংবাদিকতা ও লেখনীর গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে। সব কিছুই শূন্যের ঘর থেকে শুরু করেই তো পূর্ণ করতে হবে।
ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজের স্পোর্টস পেজে সাবলীল লেখনীর জন্য যিনি সব সময় আলোচিত হয়েছেন পাঠকমহলে, যিনি ষাটের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট সেই জে ডেভিডসনের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবের দোতলায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শুরু হয় স্বাধীন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন উদ্যম নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখকদের পথচলা। এই সভায়ই সর্বসম্মতিক্রমে একটি কার্যনির্বাহী পরিষদও গঠিত হয়। দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা ও ক্রীড়া লেখনীর ইতিহাসে এটি একটি ঘটনাবহুল অধ্যায়ের যাত্রা। সভাপতি আবদুল হামিদ, সহসভাপতি কামরুল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান, কোষাধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন সাচ্চু, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী, আলী জাহেদ, ইকরামউজ্জমান, আবদুল তৌহিদ ও আতাউল হক মল্লিক।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ১৯৭৩ সালের সেরা খেলোয়াড়দের (ফুটবলে নাজির হোসেন, অ্যাথলেটিকসে শাহ আলম, সাঁতারে মোশাররফ হোসেন খান, হকিতে আশিক উল্লাহ কায়েস ও ভলিবলে মো. ফারুক) পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ১৯৭৪ সালে। ঢাকা স্টেডিয়ামের তিনতলায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা ও ক্রীড়ামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে এই পুরস্কার এখনো নিয়মিতভাবে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন খেলায় ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের ছাড়াও উদীয়মান ক্রীড়াবিদ, সংগঠক, কোচ, রেফারি, আম্পায়ার, জাজ, পৃষ্ঠপোষক, সক্রিয় ফেডারেশন, সংস্থা, তৃণমূলের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব এবং বিশেষ সম্মাননা। প্রসঙ্গত, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার শুরুর আগেই ক্রীড়া লেখক সমিতির পুরস্কার শুরু এবং সেই হিসেবে এটা বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়ার জাতীয় পুরস্কার।
১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমস কাভার করতে গিয়েছিলেন ক্রীড়া লেখক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আলম বাবু। গেমস চলাকালীন তিনি তৎকালীন আসপুর (এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস ইউনিয়ন) কার্যনির্বাহী সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সদস্য পদের জন্য আলোচনা করেন। চান তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা। ১৯৯২ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি সিউলে অনুষ্ঠিত আসপুর কংগ্রেসের সদস্য পদ লাভ করে। এটাই বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এরপর ১৯৯৩ সালের ৭ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এআইপিএসের ৫৬তম কংগ্রেসে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি সদস্য পদ লাভ করে। এটি সবচেয়ে বড় স্বপ্নপূরণ। স্বপ্নপূরণের এই সভায় বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রতিনিধিত্ব করেন সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন খান দুলাল। এই কংগ্রেসেই স্বাগতিক দেশের তোগাই বায়াতলি এআইপিএসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে।
বাংলাদেশ সদস্য পদ পাওয়ার পর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ৫৭তম এআইপিএস কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ইকরামউজ্জমান ও রেজাউর রহমান সোহাগ। এর পর থেকে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি প্রতিটি আসপু (বর্তমানে এআইপিএস এশিয়া) এবং এআইপিএস কংগ্রেসে অংশ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দরজা খোলার পর সমিতির সদস্যরা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। রকিবুল হাসান ১৯৯১ সালে আসপুতে নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০০ সালে আসপুর নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন ইকরামউজ্জমান। এরপর ২০০৬ সালের কংগ্রেসে তিনি সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বিএসপির একসময়ের প্রেসিডেন্ট সনৎ বাবলা এআইপিএস এশিয়ার কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছেন ২০২২ সালে। আশা করা যায়, এই ধারা অব্যাহত থাকবে আগামী দিনগুলোতেও।
বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন বদরুল হুদা চৌধুরী, ইকরামউজ্জমান, আজম মাহমুদ, কবি সানাউল হক খান, ড. রণজিৎ বিশ্বাস, মাহমুদ হোসেন খান দুলাল ও উৎপল শুভ্র। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা।
২০১৬ সালে তুর্কমেনিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম এআইপিএস ‘এশিয়ান স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন ইকরামউজ্জমান। এর আগে তিনি ২০০৬ সালে কুয়েত জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিতভাবে ক্রীড়া লেখনীতে অবদান রাখার জন্য। ২০১৮ সালে ক্রীড়াবিষয়ক লেখালেখির ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ) সংবর্ধনা দিয়েছে পাঁচজন ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিককে। তাঁরা হলেন মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, ইকরামউজ্জমান, আবদুল তৌহিদ আজম মাহমুদ ও এম এ হান্নান খান। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কামাল লোহানী। এদিকে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন ১০ জন ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখককে সম্মাননা দিয়েছে ঢাকায়। তাঁরা হলেন আব্দুল হামিদ, তওফিক আজিজ খান, বদি-উজ-জামান, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, আতাউল হক মল্লিক, আবদুল তৌহিদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, খন্দকার মনজুরুল ইসলাম (দিনু খন্দকার), শহিদুল আজম ও মোস্তফা মামুনকে।
বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন এশিয়ার সেরা ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার পুরস্কার পেয়েছে। ২০২২ সালের কার্যক্রমের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে এই স্বীকৃতি। এশিয়ার ৩০টি দেশের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয়েছে বিএসপিএ। এশিয়ান সেরা হয়েছে বাংলাদেশ। এই গৌরব শুধু ক্রীড়া সাংবাদিক, লেখক, ক্রীড়াঙ্গনের নয়-এই গৌরব দেশের সব মানুষের। ২০২৩ সালের ৯ মে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে এই পুরস্কার হস্তান্তর করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ক্রীড়া লেখনী ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যেটি একসময় কল্পনাও করতে পারেনি। পেশা হিসেবে ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, চিত্তাকর্ষক এবং উপভোগ্যও। অনেক শব্দ, কোলাহল আর কৌতূহলে ভরপুর এই পেশা। সময় হয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা ও লেখনীর সঠিক মূল্যায়নের।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সম্মানিত সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ