মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। তিনি পারস্য উপসাগরের নাম বদলে ‘আরব উপসাগর’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা ইরানজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তবে প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প বা যুক্তরাষ্ট্র আদৌ এই উপসাগরের নাম আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তন করতে পারেন কি না?
পারস্য উপসাগরের ইতিহাস
পারস্য উপসাগর নামটির ব্যবহার ইতিহাসে গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সাল থেকে এই নাম ব্যবহার হয়ে আসছে, যখন সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনে পারস্য সাম্রাজ্য একটি বিস্তৃত ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। আজকের ইরান তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধরে রেখেই এই উপসাগরের নামকে নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখে। ব্রিটিশ, গ্রিক ও অন্যান্য ঐতিহাসিক মানচিত্রেও ‘Persian Gulf’ নামটিই ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিতর্ক ও আরব বিশ্ব
তবে ১৯৫০-এর দশকে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের পর থেকে উপসাগরটির নাম ‘Arabian Gulf’ হিসেবে পরিবর্তনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। সৌদি আরবসহ কয়েকটি ধনী আরব দেশ বহু বছর ধরে এই পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে নামটি বর্জন করতে চায়।
ট্রাম্পের প্রস্তাব এ কারণেই আরব মিত্রদের প্রতি এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এর ফলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যেতে পারে।
ট্রাম্পের ক্ষমতা কতটা?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প দেশের অভ্যন্তরীণ মানচিত্র বা সরকারি ডাটাবেজে (যেমন: Geographic Names Information System) কোনো জায়গার নাম পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে পারেন। মেক্সিকো উপসাগরের নাম ‘আমেরিকা উপসাগর’ করার একটি অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত এর উদাহরণ। তবে আন্তর্জাতিকভাবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
আন্তর্জাতিক মানচিত্র ও সামুদ্রিক অঞ্চলের নামকরণে জাতিসংঘ বা ইন্টারন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফিক অর্গানাইজেশন (IHO)-এর কোনো আনুষ্ঠানিক প্রোটোকল না থাকলেও, ঐতিহাসিক স্বীকৃতি ও রাজনৈতিক সম্মতির ভিত্তিতে নামগুলো বহাল থাকে। বর্তমানে জাতিসংঘ ও অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘Persian Gulf’ নামটিই ব্যবহার করে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইরানজুড়ে দলমত নির্বিশেষে জনমত গড়ে উঠেছে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, অ্যাকাডেমিকরা, ক্রীড়া সংগঠন এবং এমনকি সরকারের বিরোধীরাও এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। #ForeverPersianGulf হ্যাশট্যাগে সামাজিকমাধ্যমে ট্রেন্ড দেখা গেছে।
ইরানের সাবেক রাজপরিবারের সদস্য রেজা পাহলভি পর্যন্ত একে ‘ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইরানিদের জন্য পারস্য উপসাগর শুধু একটি জলসীমা নয়, বরং এটি তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় অহংকারের প্রতীক।
সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ইস্যু ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইরানের কট্টরপন্থিরা বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বাস করে। এখন তারা এই ধরনের রাজনৈতিক ইঙ্গিতকে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরবে যে, আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির অন্যতম আলোচক ও কূটনীতিক হোসেন মুসাভিয়ান জানিয়েছেন, ‘এই নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ কেবল ইরানিদের জাতীয় গর্বে আঘাত হানবে না, বরং কূটনৈতিক পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলবে।’
সবশেষে বলা যায়, পারস্য উপসাগরের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাব রাজনৈতিক ও প্রতীকী হলেও, আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের পরিবর্তন বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতা তার নেই। ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর প্রতি একপাক্ষিক সমর্থনের বার্তা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কিতই থেকে যাবে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস
বিডি প্রতিদিন/জামশেদ