আরবি শব্দ ‘সাক’-এর বহুবচন সুকুক। আরবি এই শব্দ দ্বারা কোনো দলিলে সিলমোহর লাগিয়ে কারো কাছে অধিকার ও দায়িত্ব অর্পণ করাকে ‘সুকুক’ বোঝায়। এটি দ্বারা আইনগত সনদ বা দলিল ইত্যাদিও বোঝানো হয়। ‘সুকুক’ একটি শরিয়াসম্মত অর্থনৈতিক দলিল (ফিন্যানশিয়াল সার্টিফিকেট), যা সমমূল্যের কোনো সম্পদ বা সেবার মালিকানায় বিশেষ বিনিয়োগের অবিভাজ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
প্রচলিত সুদভিত্তিক বন্ডের বিকল্প হিসেবে সুকুক বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। সুকুক দলিলের মাধ্যমে কোনো সম্পদ যেমন—ভূমি, ভবন, কারখানা অথবা অন্য কোনো সম্পদের মালিকানায় অংশগ্রহণ করা হয়।
সুকুকের সংজ্ঞা : বাহরাইনভিত্তিক ইসলামী গবেষণা এবং স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ব্যাংকস’ (আউফি)-এর শরিয়া স্ট্যান্ডার্ডে বলা হয়েছে, ‘সুকুক সমমূল্যের এমন সম্পদ, যা কোনো বিদ্যমান নির্দিষ্ট সম্পত্তি অথবা সম্পদের উপস্বত্ব অথবা সেবা অথবা নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্প বা বিশেষ বিনিয়োগ কার্যক্রমের অধিভুক্ত সম্পত্তির অভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে।’ মালয়েশিয়ার ইসলামিক ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড-এর মতে, ‘সুকুক এমন একটি সনদ, যা তার বাহকের জন্য সংশ্লিষ্ট সম্পদের অবিভক্ত কোনো অংশের সম্পৃক্ত মালিকানার প্রতিনিধিত্ব করে যদি বাহক উক্ত সম্পদের যাবতীয় অধিকার ও দায়িত্ব পরিগ্রহ করে।’
সুকুকের বৈশিষ্ট্য : ইসলামী বন্ড সুকুকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো : ক. সুকুক ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সম্পদে সুকুকের বাহকের মালিকানা সাব্যস্ত হয়। তাই এই আর্থিক সনদ সংশ্লিষ্ট সম্পদে বাহকের অংশীদারিত্ব বহন করে। মালিকানা বিবেচনায় সুকুকধারী সুকুক ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি ও ঝুঁকির ভাগীদার হয়। খ. সুকুক জারিকারী সুকুকের ধারককে মুনাফা ভাগাভাগিতে যুক্ত করে।
এখানে অর্থ জোগানদাতা (সুকুকধারক) রাব্বুল মাল বা সাহিবুল মাল হিসেবে পরিগণিত হয়। আর ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প পরিচালক মুদারিব হিসেবে বিবেচিত হন। গ. সুকুক বিনিয়োগযোগ্য আর্থিক দলিল। ঘ. সুকুক ইস্যুর প্রতিটি ধাপে শরিয়া পরিপালন নিশ্চিত করা হয়।
সুকুকের প্রকারভেদ : বিশ্বব্যাপী সুকুকের বাজার দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এরই প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছে নানা প্রকারের সুকুক। বিভিন্ন চুক্তির ওপর ভিত্তি করে সুকুক চার ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা : ১. বিক্রয়ভিত্তিক। যেমন—মুরাবাহা (লাভে বিক্রি), সালাম (অগ্রিম ক্রয়) ও ইসতিসনা (আদেশে পণ্য তৈরি) সুকুক। ২. ভাড়াভিত্তিক যেমন—ইজারা (ভাড়া), ইজারা মুতানাহিয়া বিত তামালিক, ইজারা মাওসুফাহ বিয-যিম্মাহ। ৩. অংশীদারিত্বমূলক যেমন—মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি) ও মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি)। এবং ৪. প্রতিনিধিত্বমূলক যেমন—ওয়াকালাহ বিল ইসতিছমার।
বাণিজ্যিক কার্যকলাপের ভিত্তিতে সুকুক আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন—১. করপোরেট সুকুক : বেসরকারি বিভিন্ন কম্পানি এই সুকুক ইস্যু করে। ২. সার্বভৌম সুকুক : সরকার বা স্বায়ত্তশাসিত কোনো সংস্থা এই সুকুক ইস্যু করে। ৩. বিনিময়যোগ্য সুকুক : যে সুকুক মেয়াদ শেষে মূলধন বা শেয়ারে রূপান্তর করা যায়। ৪. অধীনস্থ বা সাবোরডিনেট সুকুক : এখানে সুকুকের প্রত্যর্পণ বিনিয়োগকারীর অধীনস্থ হয়। ৫. যুক্ত সুকুক : এ ক্ষেত্রে দুটি দলিল এমনভাবে আটকানো থাকে, যাতে তা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না।
সুকুক বনাম বন্ড : সুকুক ও বন্ড—দুটি দ্বারাই আর্থিক সম্পদ বোঝায়। এই দুটি আর্থিক সম্পদই কোনো না কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন বা এর আর্থিক চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। তবে এই দুটি আর্থিক সনদে অনেক ফারাক রয়েছে। এক. সুকুক মুনাফাভিত্তিক, আর বন্ড সুদভিত্তিক আর্থিক সনদ। দুই. সুকুক ইস্যুর জন্য কমপক্ষে ৫১ শতাংশ সম্পদ দৃশ্যমান থাকতে হয়। বন্ডের বেলায় দৃশ্যমান সম্পদের প্রয়োজন নেই। তিন. সুকুকসংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট সম্পদে মালিকানার অংশ বোঝায়। বিপরীতে বন্ড ইস্যুকারীর ঋণ নির্দেশ করে। চার. সুকুকের ধারকসংশ্লিষ্ট সম্পদ/প্রকল্প/সেবায় মালিকানার দাবিদার।
অন্যদিকে বন্ডধারক ঋণসংশ্লিষ্ট প্রকল্প বা কম্পানিতে ঋণদাতার ঋণের দাবিদার। পাঁচ. সম্পদে মালিকানা থাকায় সুকুক নিরাপদ ও সংরক্ষিত। বন্ড সাধারণত অনিরাপদ ও জামানতবিহীন ঋণপত্র। ছয়. সুকুক ইস্যুকারীর পক্ষে থেকে মূলধন ও লাভ কোনোটারই গ্যারান্টি নেই। বন্ড ইস্যুকারীর পক্ষ থেকে গ্যারান্টি আছে। সাত. ইসলামী বন্ড শরিয়া নির্ধারিত ক্ষেত্র ছাড়া জারি করা যায় না। বন্ড যেকোনো উদ্দেশ্যেই ইস্যু হতে পারে। (লেখক : শিশু সাহিত্যিক, গবেষক ও ইসলামী অর্থনীতিবিদ)
