জাহেলি বর্বর যুগে পেশিশক্তির জোরে খুন-হত্যা ও অত্যাচার-নির্যাতন চলত অবাধে। খুঁটিনাটি অজুহাতে ঝগড়াবিবাদ চলত যুগ যুগ ধরে। ইসলাম আগমনের পর এসব অমানবিক কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। ইসলাম ধর্মে খুন করা, খুনের পরিবেশ তৈরি ও ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ধর্মীয় কর্মসূচি বা যে কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হিংস্র উত্তেজনা ও সস্তা আবেগপ্রবণ হয়ে খুন, গুম, অপহরণ, হত্যা, গুপ্তহত্যা, পরিকল্পিত আক্রমণ, সহিংসতা ও উন্মাদনার কোনো অবকাশ এ ধর্মে নেই। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের মর্যাদা পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের এই দিনে, এই মাসে ও এই শহরে কারও ক্ষতিসাধন করা তোমাদের ওপর হারাম।’ (সহিহ বুখারি)।
মানবজাতির জীবন, মাল-সম্পদ ও মর্যাদা সবকিছুই আল্লাহর পবিত্র আমানত। যে এ আমানত লঙ্ঘন করে খুন, হত্যায় লিপ্ত হবে, তাকে আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ জগতে হত্যার পরিবর্তে হত্যার কঠিন শাস্তি তাকে পেতে হবে। পরকালে অনন্তকাল জ্বলতে হবে জাহান্নামের আগুনে। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তার প্রতি আল্লাহর লানত। আল্লাহ তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (সুরা নিসা-৯৩)।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তামাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক না করে। কারণ সে জানে না, হয়তো শয়তান তার হাত থেকে তা বের করে দিতে পারে, ফলে সে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
খুন-হত্যা সামাজিক অন্যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধ। বর্বর অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। নিজের স্বার্থ হাসিলের মোহে, প্রতিশোধ গ্রহণের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তারা মানবতার শত্রু, দেশের শত্রু, আল্লাহ ও রসুলের লানতপ্রাপ্ত। বিশ্বের সব ধর্ম নরহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নিষেধ করা হয়েছে সব দেশের রাষ্ট্রীয় আইনে। নরহত্যা নিকৃষ্টতম মহাপাপ। কিয়ামতের দিন হত্যার বিচার করা হবে সবার আগে। বিচারের প্রথম তালিকায় থাকবে খুন-হত্যার বিচার। মহানবী (সা.) ফরমান, ‘কিয়ামত দিবসে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দামার ফায়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত সম্পর্কিত।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)। অন্যায়ভাবে একজন মানুষ হত্যা করাকে কোরআনে কারিমে সমগ্র মানব জাতিকে হত্যার নামান্তর আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ (সুরা মায়িদা-৩২)।
হত্যার প্ররোচক এবং সহায়ক হিসেবে ইসলাম ধর্মে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, কুধারণা, পরনিন্দা, গোপনীয়তা সন্ধান এবং পশ্চাতে নিন্দা করাকে হারাম করা হয়েছে। কোরআনে নির্দেশনা এসেছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অতি অনুমান করা থেকে দূরে থাক, কেননা অনুমান করা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। আর তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা কর না।’ (সুরা হুজরাত-১২)।
খুন-সন্ত্রাস বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা। অপ্রিয় হলেও সত্য, সাম্প্রতিককালে একটি চক্র ধর্মীয় বেশভূষাধারী ছদ্মাবরণে খুন-সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে। ধর্মের নামে এরা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব গর্হিত কর্ম ধর্মকে কলুষিত করার একটি নতুন চক্রান্ত। অনাকাঙ্ক্ষিত ওই সব চক্রান্ত প্রতিরোধের জন্য সমাজের বিবেকবান লোকদের সচেতন হতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জনমত গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসনে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত, তোমরা তোমাদের ভাইকে সাহায্য কর। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি তো অত্যাচারিতকে সাহায্য করব, অত্যাচারীকে কীভাবে সাহায্য করি? তিনি তাকে বললেন, অত্যাচারীকে অত্যাচার থেকে নিবৃত কর, এটাই অত্যাচারীর প্রতি তোমার সাহায্য।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা খুন-সন্ত্রাস পরিচালনা করে, তারা প্রিয় নবী (স.) এর শিক্ষা ও আদর্শ থেকে দূরে, অনেক দূরে। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, সমাজ ও দেশকে অস্থিতিশীল এবং আতঙ্কগ্রস্ত করে পার্থিব স্বার্থ অর্জন করা।
তারা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী। ইসলামের সঙ্গে আদৌ তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অতএব, যারা ধর্মের নামে ছদ্মাবরণে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার অশুভ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তাদের জালে আবদ্ধ হওয়া থেকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা