ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা মানুষকে পরকালীন মুক্তির পথ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ইহকালীন শান্তির পথও বাতলে দিয়েছে। যার অন্যতম উপায় হচ্ছে হুসনুল খুলক তথা সদাচরণ। একজন আদর্শিক মুসলিম কেবল ইবাদতের মাধ্যমে নয়, বরং উত্তম নৈতিকতা, সদাচরণ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেও তার পূর্ণ ঈমানের পরিচয় প্রকাশ করেন।
একজন মুসলিম যদি সত্যিকার অর্থে সদাচরণকে জীবনের অংশ করে তোলেন, তাহলে তার ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরেও এক ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়।
ইসলামে সদাচরণের গুরুত্ব :
আরবি ভাষায় সদাচরণকে বলা হয় ‘হুসনুল খুলুক’ অর্থাৎ সুন্দর চরিত্র বা উত্তম নৈতিকতা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করে বলেন- ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা আল-কলম, আয়াত : ৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র উত্তম।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৩৫)
তিনি আরো বলেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য। ’(মুয়াত্তামালিক, হাদিস : ১৬১৪) অতএব ইসলামে সদাচরণ কেবল একটি গুণ নয়, বরং তা নবুয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ব্যক্তিজীবনে সদাচরণের প্রভাব :
সচ্চরিত্র একজন মুসলিমের আত্মিক উন্নতি ঘটায় এবং তাকে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের কাতারে পৌঁছে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যই আছে জান্নাতুল ফিরদাউস।’ (সুরা আল-কাহফ : ১০৭)
সদাচরণ আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, বিনয়, শিষ্টাচার ও মানবিক বোধ জাগ্রত করে। একজন সদাচারী ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পারে, ক্ষমা চাইতে জানে এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
পারিবারিক জীবনে সদাচরণের প্রভাব : সদাচরণ পরিবারে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার আবহ তৈরি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৯৫)
সদাচরণের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৌহার্দ্য, পিতা-মাতার প্রতি সম্মান এবং সন্তানদের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।
সামাজিক জীবনে সদাচরণের প্রভাব :
একটি সুস্থ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সদাচরণ অপরিহার্য। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। মন্দকর্ম ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’ (সুরা আল-মায়িদাহ, আয়াত : ২)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান সেই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০) একজন সদাচারী মুসলিম মিথ্যা বলে না, কাউকে ঠকায় না, গীবত করে না, বরং অন্যের কল্যাণে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সদাচরণের প্রভাব :
ইসলামের ইতিহাসে বহু অমুসলিম জাতি মুসলিমদের সদাচরণ দেখে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে মুসলিম বণিকদের সদ্ব্যবহার এবং চরিত্র দেখে স্থানীয়রা ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা বিদ্যমান রয়েছে। উমর (রা.)-এর খিলাফতকালীন তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের কারণে ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলেও কোনো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
সমকালীন বাস্তবতায় সদাচরণের গুরুত্ব :
আধুনিক সমাজে যখন দুর্নীতি, প্রতারণা, হিংসা, অসহিষ্ণুতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন ইসলামের এই নৈতিক শিক্ষাই হতে পারে সুস্থ মানবতা ও টেকসই সমাজ গঠনের পথনির্দেশনা। ইসলাম কেবল মসজিদভিত্তিক ইবাদত চায় না; ইসলামের চাওয়া হচ্ছে, ব্যক্তি অফিসে, রাস্তায়, পরিবারে, রাজনীতিতে, সর্বত্র ন্যায়, সততা ও সদাচরণের প্রতিচ্ছবি হবে।
সদাচরণ কেবল ব্যক্তি উন্নয়নের উপকরণ নয়, বরং এটি সামষ্টিক সমাজবদ্ধ জীবনের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার উৎস। যদি আমরা সদাচরণের আদর্শে ফিরে আসতে পারি, তাহলে বিশ্ববাসী ইসলামের বাস্তব সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতে পারবে।
তাই আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আচার-আচরণ, ব্যবহার, রাজনৈতিক ভাষা, ব্যাবসায়িক পদ্ধতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কসমূহে নববী উত্তম চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ