২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১১:৩২

বাংলায় এনআরসি আতঙ্ক; আতঙ্কে ১২ জনের মৃত্যু

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

বাংলায় এনআরসি আতঙ্ক; আতঙ্কে ১২ জনের মৃত্যু

বৃহস্পতিবার সকাল তখন সাড়ে ১০টা! নিউমার্কেটে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সদর দফতরে এসেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাবিনা বিনি ও তার সাত বছরের মেয়ে হেনা খাতুন। সকাল ছয়টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মেয়ের জন্মের সনদ নিতে। তপসিয়া থেকে নিতাই ভট্টাচার্য এসেছেন, ছেলের জন্মের সনদের ভুল সংশোধন করাতে। সাবিনা কিংবা নিতাই-এর মতো এরকম শতাধিক মানুষ গত কয়েক দিন ধরে কলকাতা কর্পোরেশনের মতোই রাজ্যটির প্রতিটি পৌরসভা, কর্পোরেশন, বিডিও অফিসগুলিতে। তার একটাই কারণ এদের সকলকেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) আতঙ্ক।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বারবারই বলছেন যে তার সরকার কোনভাবেই এ রাজ্যে এনআরসি চালু করতে দেবে না। কিন্তু গত ৩১ আগস্ট আসামে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর বিজেপি চায় বাংলাতেও এনআরসি চালু হোক। এই প্রেক্ষিতে মুসলিম সংগঠনগুলির তরফে লিফলেট বিলি, সেমিনার ও মানুষকে তাদের নথি প্রয়োজনীয় সংগ্রহের কথা বলায় গুজব আরও ছড়িয়েছে। ফলে দেশ ছাড়া হওয়ার ভয় থেকেই নাগরিকত্বের প্রমাণ বা নথি সংগ্রহের তাগিদে নাওয়া-খাওয়া ভুলে তারা ভিড় জমাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলিতে।

কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ জানান, প্রতিদিন প্রায় ২৫০ মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্মের সনদ, মৃত্যুর সনদ কিংবা সনদের ভুল সংশোধন করার জন্য। কিন্তু কর্পোরেশনের তরফে দিনে এক শতাধিক মানুষকে সেবা দেওয়ার মত ক্ষমতা আছে। এগুলো হচ্ছে এনআরসি নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের কারণে, সেই কারণেই তারা সকলেই অল্প সময়ের মধ্যে করিয়ে নেওয়ার কারণে ছুটে আসছে। এই গুজব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিদিন আতঙ্কগ্রস্থ না হওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ইস্যুকে ঘিরে সাধারণ মানুষ কিছুতেই আতঙ্ক মুক্ত হতে পারছেন না। এটা কেবল কলকাতার ছবি নয়, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়েই এই আতঙ্কের ছবি স্পষ্ট।

এনআরসি ইস্যুতে রাজ্যটিতে রাজনৈতিক লড়াইও তুঙ্গে। বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতারা রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে জানাচ্ছেন এ রাজ্যে এনআরসি হবেই। কেউ তা রুখতে পারবে না। যেটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। প্রতিবাদে তৃণমূল নেত্রী মমতা নিজেই রাস্তায় নেমেছেন, দলের বিধায়ক ও ব্লক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বোঝান। এমনটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবং তার বক্তব্যসহ ভিডিও প্রকাশ করে মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে রাজ্য সরকার। ভিডিওতে মমতা নিজেই জানাচ্ছেন যে বাংলাতে এনআরসি কখনওই হবে না। দয়া করে গুজবে কান দেবেন না। জনগণনা একটা রুটিন প্রক্রিয়া, প্রতি দশ বছর পর পর এটা হয়ে থাকে।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা, মানুষের চোখে মুখে আতঙ্ক। এনআরসি আতঙ্কে এখনও পর্যন্ত ১২ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এই ইস্যুতে শেষ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার সকালে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মুর্শিদাবাদ জেলার হরিহরপাড়ার বাসিন্দা গিয়াসুদ্দিন শেখ-এর। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, কয়েকজন প্রতিবেশি যখন তাকে বলে যে এ রাজ্যেও এনআরসি চালু হবে- তা শুনেই তিনি তার নাগরিকত্বের পুরনো নথি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। নথি না পাওয়াতেই কিছুটা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। গত দুই দিন ধরে বাড়ির সদস্যদের সাথে ভাল করে কথা বলছিলেন না।

এমন এক পরিস্থিতিতে আগামী ১ অক্টোবর কলকাতায় আসতে চলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ওই দিন কলকাতার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এনআরসি ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন অমিত শাহ। সব মিলিয়ে এই ইস্যুতে রাজ্যের রাজনৈতিক পারদ তুঙ্গে। 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর