পশ্চিমবঙ্গের ‘স্কুল সার্ভিস কমিশন’ (এসএসসি) নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বিপুল অঙ্কের অর্থের খোঁজ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শুক্রবার (২২ জুলাই) সকাল থেকে রাজ্যটির ১৪টির বেশি জায়গায় অভিযান চালায় সংস্থাটির কর্মকর্তারা। যার মধ্যে অন্যতম রাজ্যের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিল্প বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। এদিন সকালেই পার্থের দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার বাড়িতে যান ইডির কর্মকর্তারা। তার বাড়ি গিয়েই মন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর পার্থকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে রাত পর্যন্ত চলে সেই জিজ্ঞাসাবাদ।
এদিকে পার্থের বাড়িতে যখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ঠিক সে সময় রুপির পাহাড়ের খোঁজ পাওয়া যায় তারই এক ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে। পার্থ ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে ২০ কোটি রুপি উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারকৃত ওই রুপির মধ্যে রয়েছে বান্ডিলে বাঁধা ২০০০ ও ৫০০ রুপির নোট। এদিন রাতে অর্পিতার টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সাউথ সিটি বহুতল আবাসন থেকে উদ্ধার হয় ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ। জানা গেছে, এই অর্পিতা আবার নাকতলার উদয়ন সঙ্ঘের দুর্গা পূজার মডেল হয়েছিলেন। যে ক্লাবটি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বলেই পরিচিত। ইতোমধ্যেই ওই আবাসনটি ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
ইডির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাবি নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে উদ্ধার হওয়া এই রুপির যোগ রয়েছে। রুপির সঠিক পরিমাণ জানতে তা গুণতে ক্যাশ কাউন্টিং মেশিন নিয়ে অর্পিতার বাড়িতে যায় ব্যাংক কর্মকর্তারা। রুপি ছাড়াও অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার ২০টির বেশি মোবাইল ফোন। তল্লাশি অভিযানে সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রাও উদ্ধার হয়।
যদিও ইডির প্রাথমিক লিস্টে অর্পিতার নাম ছিল না বলেই জানা যায়। পরে তদন্ত করতে গিয়েই অর্পিতার নাম ওঠে আসে। তার খোঁজ করতেই এদিন রাতে যখন তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়, সে সময় প্রত্যেকটি ঘর খোলা থাকলেও একটি ঘরে তালা বন্ধ ছিল। তা দেখে সন্দেহ হয় ইডির কর্মকর্তাদের। পরে ওই ঘরের দরজা খুলতেই চোখ কপালে উঠে ইডির কর্মকর্তাদের। দেখা যায় দুই বস্তা ভর্তি রুপি। এরপরই তাকে জেরা করে ইডির কর্মকর্তারা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে এল, ২০টি মোবাইল ফোন কী কাজে ব্যবহার করা হতো, ওই বহুতল আবাসনে অর্পিতার আর কোনো ফ্ল্যাট আছে কি না তাও দেখা হচ্ছে। ওই রুপির বিষয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিছু জানেন কি না তা জানা হচ্ছে।
পরে ইডির তরফ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের ছবি সহ টুইট করা হয়। সেখানে লেখা হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে।’ উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে নবম ও দশম শ্রেণিতে শিক্ষক, গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগ মামলায় প্রায় ৫০০ কোটি রুপির দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। এই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পার্থ চ্যাটার্জি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই।
দুর্নীতির অভিযোগ আসার পরেই কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। তারা মূলত এই মামলার ফৌজদারির দিকটি দেখছে। কাদের হাত ধরে এই দুর্নীতি হয়েছে তা খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে সিবিআই-এর তদন্তকারী কর্মকর্তারা। অন্যদিকে এই মামলায় আর্থিক দুর্নীতির দিকটি খতিয়ে দেখছে ইডির কর্মকর্তারা। তারই অংশ হিসেবে এদিন রাজ্যের ১৪টি জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক পরেশ অধিকারী, তৃণমূল বিধায়ক ও পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিব সুকান্ত আচার্য, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা পি.কে বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থের আত্মীয় কল্যাণময় ভট্টাচার্য, এসএসসি’এর সাবেক উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, স্কুল শিক্ষা দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর অলোক কুমার সরকার, পর্ষদ সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচী, সাবেক পার্শ্বশিক্ষক চন্দন মন্ডল’র মতো অভিযুক্তদের বাড়িতেও অভিযান চালায় ইডি।
এর আগেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কয়েক দফায় জেরা করেছে সিবিআই। ইতোমধ্যেই এই দুর্নীতির মামলায় নাম জড়িয়েছে পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীও। অভিযোগ মেরিট লিস্টে নাম না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র রুপির জোরে চাকরি পান অঙ্কিতা। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষকতার চাকরি যায় অর্পিতার। শুধু তাই নয়, স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে গত কয়েকবছর ধরে যে বেতন পেয়েছিলেন তাও দুই কিস্তিতে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে ফেরতে নির্দেশ দেয় আদালত।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর