তারায় মোড়ানো রাতের আকাশ। চাঁদের হাসি পৃথিবীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরোনো রাত। একেক মানুষের কাছে রাত এসেছে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ্য হয়ে। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের রাত কাটে প্রভুর কদমে সেজদায় লুটিয়ে। জীবনের গুনাহ-খাতা মনে করে ক্ষমার আশায় প্রভুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার এ রাতগুলো সোনায় মোড়ানো কোনো সন্দেহ নেই। কেননা কোরআনে বিশ্বাসী বান্দার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে এ বিশেষ সময়ে বিশেষ আমলটির কথা উদ্ধৃত করেছেন আল্লাহতায়ালা। সুরা আলে ইমরানের ১৭ নম্বর আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহ বলেন, ‘মুসতাগফিরিনা বিল আসহার। অর্থাৎ তারা শেষ রাতের ক্ষমা প্রার্থণাকারী সৌভাগ্যবান বান্দা।’
আরবি ‘মুসতাগফিরুনা’ শব্দটি ‘মুসতাগফিরুন’ শব্দের বহুবচন। মুসতাগফিরুন ইসমে ফায়েলের সিগাহ। বাবে ইসতিফআল থেকে এসেছে। বহুবচনে অর্থ দাঁড়ায় ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। একইভাবে আসহার শব্দটিও বহুবচন। একবচন হলো সাহরুন। বহুবচনে অর্থ দাঁড়ায় রাতের শেষ সময়গুলো। পবিত্র রমজান মাসে যে সময়ে আমরা সাহরি খাই এখানে সে সময়টাকেই আসহার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোরের আগের সময় হলো সাহর বা সাহরির সময়। ‘মুসতাগফিরিনা বিল আসহার’ অর্থ বিশ্বাসী বান্দারা রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থনা করে।’
লেখার এ পর্যায়ে আল্লাহতায়ালা একটি চমৎকার চিন্তা কলবে ঢেলে দিয়েছেন। ভুলে যাওয়ার আগে বলে ফেলি। সুরা আলে ইমরানের ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুমিনদের পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, দানশীল ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী।’ আয়াতের অনুবাদটি আবার পড়ুন। মুমিন ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, দানশীল ও শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী হবে। ৫ নম্বর বৈশিষ্ট্যটি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন। তারা শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী। সুবহানাল্লাহ। পৃথিবীর মানুষের বুকে দীর্ঘদিন পুষে রাখা একটি ভুল ভেঙে দিয়েছে এই একটি শব্দই। তারা শেষ রাতে ক্ষমা চায়। কেন ক্ষমা চায়? গুনাহর জন্য। কিসের গুনাহ? যারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ও দানশীল তাদের কি কোনো গুনাহ থাকতে পারে? আমরা ভাবি মুমিন-মুত্তাকি-পরহেজগার মানেই নিষ্পাপ মাসুম হতে হবে। শুধু আমরা নই। পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষই এমনটি ভেবে থাকে। তাদের ফাদার, ধর্মগুরুরা নিষ্পাপ হবেন। কিন্তু কোরআন বলছে ভিন্ন কথা। পরহেজগার হওয়ার জন্য নিষ্পাপ হওয়া জরুরি নয়। পাপ-পুণ্য মিলেই মানুষ। কোনো সম্মানিত ব্যক্তি বা আলেম যদি প্রবৃত্তির তাড়নায় কোনো গুনাহ করে ফেলেন, সেটা স্বাভাবিকভাবেই দেখতে হবে। এজন্য ‘ওভার রিয়েক্ট’ করা যাবে না। কারণ মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো গুনাহ হয়ে গেলে সে ক্ষমা চেয়ে নেবে। মুত্তাকি হয়েছে বলে একেবারেই গুনাহ হবে না, এ ধারণা কোরআনবিরোধী। আরও একটি চিন্তার দুয়ার খুলে গিয়েছে। হয়তো ওপরে যা বললাম তা আয়াতের একটি ভাবার্থ। মুসলমানের সমাজে কাউকে গুনাহ করতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাকে নিয়ে কানাঘুষা করার সুযোগ নেই। বরং আরও বেশি দরদি হয়ে তাকে ক্ষমার নদীতে গোসল করার সুযোগ করে দেওয়াই সমাজের প্রতিটি মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। এর ফলে ওই গুনাহগার বান্দার প্রতি কুধারণা করে কিংবা তার গিবত করে যে গুনাহ হতো সেটা থেকে সবাই বেঁচে গেল। একইভাবে যে মুমিন ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ও দানশীল স্বভাবতই তার মনে শয়তান জায়গা করে নিতে পারে ইবাদতের অহংকারের রূপ ধরে। যদি একটিবারও তার মনে হয়, আমার মতো খাঁটি মুমিন আর কেউ নেই, যারা পাপী তাদের চেয়ে আমি অনেক ভালো, ইবাদতের জোরে আমি জান্নাতে যাব, ব্যস, তার সব আমল তো বরবাদ হবেই, তার ইমানও ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, তারা যথেষ্ট পরহেজগার হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের আমল নিয়ে কোনো অহংকার হয় না। বরং সব সময় ভয়ে তটস্থ থাকে কোথাও কোনো ভুল হয়ে গেল কি না। যে কারণে সারা দিন সত্য বলে, দানখয়রাত করে ও আল্লাহ আল্লাহ রসুলের অনুগত থেকেও রাতের শেষে ক্ষমার চাদরে নিজেকে পেঁচিয়ে নেওয়ার কাকুতিমিনতি করে।
শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনার ফলে বান্দা অহংকার থেকে মুক্ত থাকে। আর সমাজ মুক্ত থাকে গিবত-কুধারণার মতো কবিরা গুনাহ থেকে। একটি মাত্র শব্দ দিয়ে আল্লাহতায়ালা পরহেজগার বান্দাকেও বাঁচালেন, সমাজের সবাইকেও নিরাপদ রাখলেন। এই হলো কোরআনের শব্দভান্ডারের মোজেজা। প্রিয় পাঠক! ভুল মানুষই করে। সে ভুল নিয়ে বসে থাকলে চলে না। তাই আল্লাহ মানুষের জন্য ক্ষমার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। শেষ রাতে ক্ষমার হাত বাড়িয়ে বান্দাকে ডাকতে থাকেন আল্লাহ।
আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। আর আপনার কাছে যারা ক্ষমা চায়, তাদেরও ক্ষমা করে দিন। হয়তো কোনো আমলের কারণে নয় অন্যকে ক্ষমা করার অসিলায় আল্লাহও আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট