দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই বাংলাদেশে পুশইন করে যাচ্ছে ভারত। গত তিন মাসে তিন হাজারের বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। এদের মধ্যে শতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার বৈধ চ্যানেলে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হলেও পুশইন অব্যাহত রেখেছে নয়াদিল্লি। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি বাড়তে পারে সীমান্ত উত্তেজনার শঙ্কাও।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্রে জানা যায়, গত ৭ মে থেকে দেশের খাগড়াছড়ি, কুড়িগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, ফেনী, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরসহ আরও কয়েকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে দেড় হাজারের বেশি পুশইন করা হয়েছে। এমনকি সুন্দরবনের গহিন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকা দিয়েও শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে পুশইন করেছে ভারতের বিভিন্ন বাহিনী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুশইন ইস্যুতে এখন পর্যন্ত ভারতকে মোট পাঁচটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। এসব চিঠিতে পুশইনের ঘটনাকে গভীর উদ্বেগজনক এবং দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরির হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সঙ্গে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে না দিয়ে আদি নিবাস মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ভারতকে অনুরোধ করা হয়। এদিকে ভারতের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের কোনো অভিযোগই তারা মেনে নিচ্ছে না, বরং এটি কোনো প্রমাণ ছাড়া তোলা অভিযোগ। ভারত ২ হাজার ৪৬১ জনের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অনুরোধ আগেই পাঠিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো যাচাই সম্পন্ন করেনি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, ভারতীয় তালিকা যাচাই করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখনো পুশব্যাক বা পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিজিবি ও পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, পতাকা বৈঠক এবং কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও পুশইন বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিএসএফ এবং অন্যান্য ভারতীয় সংস্থার দ্বারা ঠেলে দেওয়ার ঘটনা দুঃখজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। পুশইনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। নজরদারির পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের পুশইন করা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। দেশের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার লক্ষ্যে তাদের ঠেলে পাঠানো হচ্ছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। বিষয়টি আমরা হাইকমান্ডকে অবহিত করেছি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের অব্যাহত পুশইন গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে ভারত পুশইনের সুযোগ নিয়ে কোনো বড় অপরাধীকেও পাঠাতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না পাঠিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়েও রহস্য সৃষ্টি হচ্ছে। এতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকবেই। এদিকে ভারতের অব্যাহত পুশইনে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন দেশটিতে বসবাসরত ২০ কোটির বেশি মুসলমান। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সরকারের এমন অবস্থান দেশটির প্রায় ২০ কোটিরও বেশি মুসলমানের মধ্যে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলের মুসলমানরা সবচেয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। লাখো মানুষকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলা হয়েছে। আসামের বাসিন্দা রাহিমা বেগম বলেন, আমার জন্ম ভারতে। আমার মা-বাবা, দাদা-দাদিও এখানকার মানুষ। মে মাসের শেষ দিকে পুলিশ আমাকে কয়েক দিন ধরে আটকে রাখার পর বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে আরও পাঁচজন সঙ্গে আমাকে একটি জলাভূমিতে নামিয়ে দেয় বিএসএফ।
তারা দূরে একটি গ্রামের দিকে দেখিয়ে বলল- ওদিকে হামাগুড়ি দিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করলেই গুলি করব।