শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

চেনা বন্ধুর অচেনা রূপ

মির্জা মেহেদী তমাল

চেনা বন্ধুর অচেনা রূপ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের এক তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় এক যুবকের। তরুণীটি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচারের ছাত্রী। ওই যুবক নিজের নাম সাকিব খান এবং নিজেকে সরকারি চাকুরে বলে পরিচয় দেন। পরিচয় দিয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। দিনভর মেসেঞ্জারে চ্যাট হতো তাদের। অতঃপর শুরু হয় ফোনালাপ। সারা দিনই ফোনে যোগাযোগ হতো। রাত গভীর হলে গভীর হতো ফোনালাপও। একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত ফোনে। বন্ধুত্বের দেয়াল টপকে প্রেমের সম্পর্ক জড়িয়ে যায় ভার্চুয়াল পরিচয়ের সূত্র ধরে। প্রথমে যমুনা ফিউচার পার্কে দেখা হয় দুজনের। তারপর বিভিন্ন স্থানে। একান্তে সময় কাটিয়েছেন তারা। ধারণ করা হয়েছে বিশেষ মুহূর্তের ছবি। ওই ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক এভাবেই এগিয়ে নিয়ে যায় সাকিব খান। হিসাবটা মাত্র দুই মাসের। সম্পর্কের দুই মাসের মধ্যেই ঘটে ঘটনাগুলো। দুই মাসের শেষে চূড়ান্ত খেলাটি খেলে সেই যুবক। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে ফোনে ডেকে নেয় উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সামনে। সেদিন বেলা পৌনে ১টার দিকে দেখা হয় দুজনের। সেখান থেকে উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে নর্থ টাওয়ারের সামনে নিয়ে যায় ওই ছাত্রীকে। কথায় কথায় নিজের ব্যস্ততার কথা জানান দিচ্ছিল যুবক। প্রকাশ পাচ্ছিল তার অস্থিরতাও। গল্পছলে ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে টাকা উত্তোলনের জন্য বিকাশের দোকানে যায় সে। ছাত্রী দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। পাশের একটি সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ফেসবুক লগইন করে ‘থ’ হয়ে যান। ফোনটি হাতে পেয়ে অল্পসময়ের মধ্যেই ছাত্রীর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেছে সাকিব।

কয়েকদিন পর ফেসবুকে নতুন আইডি করেছেন ওই ছাত্রী। সেই আইডিতে খুদের্বাতা আসে। টাকা দাবি করেছে সাকিব। টাকা না দিলে ব্যক্তিগত ছবিগুলো ফেসবুকে ভাইরাল করা হবে। পুরো পৃথিবীটাই যেন উল্টে যায় তার। যার সঙ্গে দিনে-রাতে, সময়ে-অসময়ে এত ঘনিষ্ঠতা, শেষ পর্যন্ত সেই তার মর্যাদাহানি করবে। পরিবার, প্রতিবেশী, চেনাজনদের কাছে...। এসব ভাবতে ভাবতে বারবার সাকিবের ফোনে কল দেন। বন্ধ পান। নিজের ফোন নম্বরে (যে ফোনটি সাকিব নিয়ে গেছে) কল দিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। অভিন্ন কথা। টাকা দিতে হবে। বিকাল ৪টার মধ্যে। নতুবা ছবিগুলো ভাইরাল হবে। বাধ্য হয়েই সাকিবের দেওয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠায় দুই দফা। এভাবে প্রায়ই ছবিগুলো প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয় ছাত্রীর কাছ থেকে। বাধ্য হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন ওই ছাত্রী। এতে ওই যুবকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ক্যাপ্টেন সাকিব খান (৩১)। পিতার নাম সিহাব উদ্দিন। বাসার ঠিকানা রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার রেলস্টেশন সংলগ্ন। পুলিশ নিশ্চিত হয়, সাকিব খানের নাম-পরিচয় সবই ভুয়া।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাকিবের মতো ব্যক্তিরা মিথ্যা পরিচয় ও তথ্য ব্যবহার করে নিজেকে উপস্থাপন করে। নানা প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে তরুণীদের। গড়ে তোলে প্রেমের সম্পর্ক। একপর্যায়ে ব্ল্যাকমেইল। শুধু তরুণীদের শরীর, মন নয়, কেড়ে নেয় সর্বস্ব। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণ ও নগদ টাকা কোনো কিছুই বাদ যায় না তার কবল থেকে। কেউ ধরা পড়ে, কেউ পড়ে না। কিন্তু এই প্রতারণার ফাঁদ কমছেই না। বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এমন অসংখ্য অভিযোগ আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।  সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াদের ৪৪ শতাংশই মনে করেন, সাইবার অপরাধীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়া গেলে দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাকিদের মধ্যে ২৯ শতাংশের পরামর্শ হলো আইনের প্রয়োগ বড়ানো। ২৭ শতাংশ সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ আইনি সহায়তা নেন না- এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১৫ ভাগ। এই ব্যবহারকারীদের বিশাল অংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী। তবে অসচেতনতার কারণে সাম্প্রতি এ মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে এদের একটি বড় অংশ সহজেই দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। একই ধরনের অপরাধের শিকার হন ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুর হক বলেন, মেয়েরা ফেসবুকে কে আসল কে নকল সেটা যাচাই-বাছাই না করে খুব বেশি খোলামেলাভাবে ভার্চুয়ালি মিশে থাকে। এভাবেই একটু একটু করে তারা ফাঁদে পা দেয়। একজন টিনএজার গার্মেন্ট কর্মীও আজকাল স্মার্ট ফোন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। অথচ ফেসবুকের সিকিউরিটি বা প্রাইভেসির বিষয়ে সে কিন্তু মোটেও সচেতন নয়। একই সঙ্গে বর্তমান যুগের বাবা-মা এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে তাদের সন্তান কী করছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও অতি আহ্লাদের জায়গা থেকে সন্তানদের হাতে এই বয়সেই একটি আইফোন ধরিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হয়। অথচ ১৮ বছর বয়সের নিচে সন্তানের হাতে যে ফোন দেওয়া ঠিক না সেটা তারা একবারও ভেবে দেখে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর