শুক্রবার, ২৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করদাতাদের কষ্ট না দিয়ে রাজস্ব আদায় পরিকল্পনা

চলতি এবং আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণ চায় এনবিআর

মানিক মুনতাসির

চলমান কভিড-১৯ মহামারীর ফলে এমনিতেই দেশের সব শ্রেণির মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সরকারি ব্যয়। কিন্তু সেই হারে আয় বাড়ছে না সরকারের। কেননা কভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- থেমে গেছে। ফলে যৌক্তিক ও মানবিক কারণে করদাতাদের কাছে আগের মতো যেতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কাউকে চাপও দিতে পারছে না। এ জন্য আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এমন কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার, যাতে কর দিতে জনগণের কষ্ট হয়। নতুন বাজেটে নতুন করে কোনো করারোপ না করে কর দিতে সক্ষম কিন্তু দেন না এমন লোকদের করের আওতায় আনার বিশদ পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতির আকার দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ও             পরিমাণ। দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে বাড়ছে রাজস্ব আহরণ। সেই ধারাবাহিকতার আলোকে চলতি অর্থবছরও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই সাজানো সংসারে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে বিশ^ব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অর্থমন্ত্রী আগেই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনেন। কিন্তু মহামারীর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম মনে করেন, অর্থবছর শেষে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হতে পারে। এর বেশি কর আদায় করা চলতি বছর সম্ভব হবে না বলে এ বিষয়ে অবহিত করে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। সেখানে বাজেট ২০১৯-২০২০-এর জন্য নতুন করে টার্গেট সেট করার কথা জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। চিঠিতে তিনি জানান, এনবিআরের চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, অর্জন করা সম্ভব হবে না তাও। জানা গেছে, আগের ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আহরণের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য চলতি এবং আগামী অর্থবছর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের অনুরোধ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এতে বলা হয়, কভিড-১৯ জনিত দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা একরকম অসম্ভব হবে। এদিকে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছরই রাজস্ব আয় বাড়ছে। কিন্তু এবারই আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয় কমতে যাচ্ছে। কমার পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে তা হতে পারে বড়জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে এনবিআরের আদায় কমবে ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আদায় কমবে ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ১১ জুন। আগামী অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ধরা হচ্ছে বলে এনবিআরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রহমাতুল মুনিম এ নিয়ে চিঠিতে বলেন, এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে তিনি আশাবাদী নন। কারণ ১ জুলাই থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া রেখে যাবে।

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান অর্থবছরের সম্ভাব্য আদায়ের ওপর আগের গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ধরে হিসাব করলেও আগামী অর্থবছরের মোট আহরণ ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। এনবিআর রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও শুল্ক এই তিন খাত থেকে। এর মধ্যে মূসক থেকে ৯৭ হাজার ৫৯ কোটি, আয়কর থেকে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৭৩ হাজার ১৯২ কোটি টাকা আসতে পারে।

এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে আরও লিখেছেন, অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অসম্ভব বিবেচনা করে অনেকে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগও আসে। আর লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক হলে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে তা অর্জনের প্রচেষ্টা থাকে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কৃতিত্ব পাওয়ার অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিকীকরণের জন্য অর্থ সচিবকে অনুরোধ জানান তিনি।

 

তিনি চিঠিতে লেখেন, করোনাভাইরাসজনিত মহামারী সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কারও পক্ষেই তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ কর আহরণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের সব মানুষের ভোগ-চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় ভোগের চাহিদা কমলে আমদানি কমবে, শিল্প উৎপাদন কমলে কাঁচামাল যন্ত্রপাতির চাহিদা কমবে। এতে পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আয়বর্ধক কার্যক্রম কমলে এবং অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে কমবে প্রত্যক্ষ করও। এ ছাড়া নিকট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ জনগণের মৌলিক চাহিদা-সেবায় নিয়োজিত হবে, যার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন ও জনগণের নিরাপত্তা। এসব মৌলিক উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও সেবার বেশির ভাগই সম্পূর্ণ করমুক্ত বা ন্যূনতম করের আওতাধীন। ফলে মানুষকে কষ্ট না দিয়ে এবং হয়রানিমুক্তভাবে কর আদায়ের কথা ভাবছে এনবিআর।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রাজস্ব আহরণের জন্য দুর্দিন। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। করদাতাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থবছর শেষে দেখা যাবে ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। কারণ তাদের মুনাফা কমে যাবে। দুই মাসের ঋণের সুদের হার ও ইনস্টলমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিট (ভ্যাট ও ট্যাক্স) মোট রাজস্বের ৬০-৭০ শতাংশ আহরণ করে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকায় তা আদায় করা সম্ভব হবে না। ফলে লক্ষ্যমাত্রা সেভাবে ঠিক করাটাই বাঞ্ছনীয় হবে বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর