সোমবার, ১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

তুলসীমালার যত কদর

মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর

তুলসীমালার যত কদর

বগুড়ার দই আর নাটোরের কাঁচাগোল্লার মতোই সমাদৃত শেরপুরের চাল তুলসীমালা। এ চাল শেরপুরের অমূল্য রতন। তুলসীমালা দেখতে যেমন ছোট ও মিহি, এর রয়েছে বাহারি সুগন্ধ। তুলসীমালাকে ‘জামাই আদুরি’ চালও বলা হয়। নতুন জামাই এলেই শ্বশুরবাড়িতে অবধারিত রান্না হবে তুলসীমালার পোলাও, খিচুড়ি, পায়েস বা পিঠা। তুলসীমালা চাল রান্না হলেই মন্ডম গন্ধে ছেয়ে যাবে আশপাশ। আর এ চাল খাওয়ার পর চার-পাঁচ ঘণ্টা হাতে সুগন্ধ লেগে থাকবে। একসময় একশ্রেণির অভিজাত কৃষক এ ধান উৎপাদন করতেন। শেরপুর জেলার জমিদাররা একদা এ চালের সুস্বাদু খাবার খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। জমিদারদের বাড়িতে ইংরেজরা এলে তুলসীমালা চালের যত বাহারি খাবার পরিবেশন করা হতো। যাওয়ার সময় ইংরেজদের খুশি করতে কিছু তুলসীমালা চাল গাড়িতে তুলে দেওয়া হতো। নিকটজনদের এখনো তুলসীমালা চাল দেওয়ার রেওয়াজ শেরপুরে চালু আছে। এ ছাড়া বিশেষ কেউ এলে দুই-দশ কেজি তুলসীমালা চাল দিয়ে খুশি করা হয়।

দিন দিন দেশে ও বিদেশে বাড়ছে এই তুলসীমালা চালের কদর। এ ধানের উৎপাদন পরিমাণে কম হলেও বছরজুড়ে দাম ও চাহিদা থাকে অন্যান্য চলের দ্বিগুণ। আধুনিক হাইব্রিডের যুগে অভিজাত কৃষক ছাড়াও এখন অনেক কৃষকই এ ধান উৎপাদন করেন। তবে এ ধানের জাত কবে কোথা থেকে আনা হয়েছে তা ৮০ বছরের কৃষকও বলতে পারেন না। সবাই বলেন, ‘বাপ-দাদা থেকে আমরা পেয়েছি।’ অনেক অনেক দিন জেলার পাহাড়ি এলাকার উঁচু জমি নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী উপজেলায় সীমিত জমিতে এ ধান লাগানো হতো। এখন এ চালের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সমতল অঞ্চলজুড়ে তুলসীমালা ধানের আবাদ হয়। প্রতি বছরই বাড়ছে তুলসীমালার উৎপাদন ও চাহিদা। জেলার কৃষি অফিস থেকে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে ২ হাজার ১৮০ হেক্টর জমি থেকে তুলসীমালা চাল পাওয়া যায় ৩ হাজার ৭০৬ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ সালে ৩ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমি থেকে পাওয়া যায় ৬ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ সালে ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমি থেকে চাল পাওয়া যায় ৬ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ সালে ৩ হাজার ১২০ হেক্টর জমি থেকে চাল পাওয়া যায় ৬ হাজার ৪৫৮ মেট্রিক টন আর ২০১৯-২০ সালে চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদিত চালের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ হাজার ৬০ হেক্টর ও ৬ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন। তবে চাল কারবারিরা বলেন, এ চালের যে চাহিদা আছে এর চেয়ে উৎপাদন কম হয়। নালিতাবাড়ী উপজেলার শ্রীবাস ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মহাদেব নাথ বলেন, ‘চাল উৎপাদনের আগেই মিলমালিকদের অগ্রিম টাকা দিতে হয়। যে পরিমাণ চাল পাই দোকানে আনার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়।’

কৃষক ও কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, তুলসীমালা আলোকসংবেদনশীল আমন প্রজাতির ধান। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ ধান লাগানো হয়। অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি তুলসীমালার ফুল আসে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ (অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি থেকে পৌষের শুরু) চাল বেড়ে ওঠে। বয়সকাল থাকে ১২৫ থেকে ১৪০ দিন। ধানের রং কালচে ধূসর। ১ হাজার শুকনো ধানের গড় ওজন ১১ গ্রাম। চাল সুগন্ধি, চিকন ও অত্যন্ত সুস্বাদু। পোলাও, বিরিয়ানির জন্য বিশেষ উপযোগী। ধানগাছের উচ্চতা ১১০ থেকে ১৮৫ সেমি। গড় কুশির সংখ্যা ৮-১০টি। শীষের গড় দৈর্ঘ্য ২২-২৪ সেমি। শীষে দানার গড় সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৮০টি। এটি খরাসহিষ্ণু। সাধারণ নাবি হিসেবে কৃষক তুলসীমালা আবাদ করেন।

তুলসীমালা চালের সুনাম ও সমৃদ্ধি শত বছর আগের। সম্প্রতি শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং এখন সুগন্ধি চাল তুলসীমালা। দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা প্রজাতির সুগন্ধি ধানের চাল উৎপাদিত হলেও শেরপুরের তুলসীমালা চাল গুণ, মান, সুগন্ধে ভিন্ন। ইতিমধ্যে জেলা ওয়েবসাইট ‘আওয়ার শেরপুর’ তুলসীমালাকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। কেউ কেউ তুলসীমালা চাল অনলাইনে বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ বৃহদাকারে দেশে-বিদেশে বিক্রির বাণিজ্য করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খুচরা পর্যায়ে সাধারণত ১ কেজি তুলসীমালা চালের দাম ৮২ থেকে ৮৮ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।

এদিকে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ১৪ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে তুলসীমালা ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪ হাজার ৮০০, নকলায় ২ হাজার ৫৯০, নালিতাবাড়ীতে ৪ হাজার ৬০, ঝিনাইগাতীতে ২ হাজার ১১০ ও শ্রীবরদী উপজেলায় ৯৮০ হেক্টর জমিতে এ ধান আবাদ হয়েছে। এতে চাল হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর