সারাদিনে ব্যবসার কাজে এতই ব্যস্ত ছিল আওলাদ, নিজের অফিসে পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার স্ত্রী নাজমা শিকদার অফিসের কাজ একাই সেরে সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ফিরেছেন। নাজমা শিকদার তার স্বামীকে বারবার ফোন করেন। সর্বশেষ রাত সাড়ে ১১টায় স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয় নাজমা শিকদারের। ‘কোথায় তুমি, তাড়াতাড়ি আস। অফিসের বিষয়ে অনেক কথা আছে’, নাজমা শিকদার ফোনে জানায়। আওলাদ হোসেন জবাব দেয়, ‘বারবার ফোন দিচ্ছ কেন? আমি বাসার দিকেই ফিরছি। রাস্তায় জামে আটকে আছি। অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে স্বপন আছে।’ স্বপনের নাম শুনেই নাজমা বেগম রেগে যান। তিনি বলেন, ‘এরপরেও তুমি স্বপনের সঙ্গে আছ? তুমি কি সব ভুলে গেছ? তোমার কত ক্ষতি করেছে সে।’ ‘আরে ওকে ভুল বুঝ না। ও আমার এলাকার ছোট ভাই। আগের সব ব্যাপারে আমার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি চলে আসব তাড়াতাড়ি’, বলে আওলাদ। নাজমা শিকদার স্বামীর অপেক্ষায় থাকে। বেশ কিছু সময় পর আবারও ফোন দেয় নাজমা শিকদার। কিন্তু ফোন ধরে না আওলাদ। বেশ খানিকটা সময় পর আবারও ফোন দেয়। এবার ফোন বন্ধ। নাজমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় তার বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে। একবার বারান্দায় যায়, আবার রুমে ফিরে আসে। রাত বাড়ে তার টেনশনও বাড়তে থাকে। হয়তো বন্ধুদের নিয়ে কোথাও বসেছে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় নাজমা। বাসায় ফিরলে এবার এর একটা বিহিত করতেই হবে। এমন সব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন নাজমা। ঘুম ভাঙে চেঁচামেচিতে। বাসার সামনে লোকজনের চেঁচামেচি। বারান্দায় দৌড়ে যায় নাজমা। নিচে একটি পিকআপ ভ্যান দেখতে পান। পিকআপ ভ্যানে চাটাই পেঁচানো লাশের মতো। ঘুম জড়ানো চোখে তিনি কি ভুল দেখছেন? চোখ কচলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। পিকআপের সামনে দাঁড়ানো স্বপন! এবার ভয় পায় নাজমা। দৌড়ে নিচে যায়। পিকআপের সামনে। স্বপন তাকে জানায় রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে আওলাদ। পাহাড় ভেঙে পড়ে নাজমার ওপর। চিৎকার করে কিছু বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। ছুটে আসে নাজমার দুই সন্তান। বাবার লাশ ধরে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নাজমা শিকদার এ সময় স্বপনকে বলে, ‘তুই খুন করেছিস আমার স্বামীকে। এখন তুই মিথ্যা বলছিস। সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা যেতে পারে না। তোকে আমি পুলিশে দিব।’ এ সময় সেখানে আসে সফি। স্বপনের আরেক বন্ধু। সফিকে দেখে নাজমা বলে, ‘তোরা দুজন মিলে খুন করেছিস।’ পুলিশ আসে। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে পুলিশ। থানায় যায় নাজমা শিকদার। হত্যা মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ গড়িমসি করে। তারা মামলা নেয় না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টের আগে হত্যা মামলা নেবে না বলে পুলিশ জানিয়ে দেয়। প্রাথমিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে আওলাদের। পুলিশও নিশ্চিত হয়। খুন নয়, দুর্ঘটনা। দাফন করা হয় আওলাদের লাশ। কিন্তু নাজমা শিকদার বিশ্বাস করেননি। তিনি নিশ্চিত এটি খুন। তাই দমে যাননি। তিনি এর শেষ দেখতে চান। ব্যবসার চিন্তা বাদ দিয়ে স্বামী হত্যার বিচারের জন্য মাঠে নামেন। তিনি থানা, পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় পর তিনি প্রমাণ করতে সমর্থ হন, এটি দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। তার ব্যবসায়ী স্বামীকে সেই স্বপন আর শফি মিলেই হত্যা করেছে। আর এটি প্রমাণ করতে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত করতে হয় লাশের। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করে জানতে পারে এটি খুন। ঘটনাটি গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেন হত্যাকান্ডটি বেশ আলোচিত ছিল।
সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই মাঠে নেমেছিলেন। দুজন একসঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। স্টকলটের ব্যবসায় আওলাদ হোসেন খুব দ্রুতই উন্নতি করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঘাতকরা তাদের বেশি দূর যেতে দেয়নি। থামিয়ে দিয়েছে তাদের অগ্রযাত্রা। একজন উদীয়মান ব্যবসায়ীকে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনিরা পরিকল্পিতভাবে দুর্ঘটনা বলে প্রচার করে আসছিল। কিন্তু খুনিরা শেষ রক্ষা পায়নি। পুলিশের তদন্তে ঠিকই বেরিয়ে আসে তাদের নির্মমতা। টঙ্গীর গাজীপুরার সাতাইশ রোডের নিজ বাসা থেকে ৯ সেপ্টেম্বর রাতে স্টকলটের মাল কেনার কথা বলে ডেকে নেয় খাঁপাড়া এলাকার সফিকুল ইসলাম ওরফে স্বপন খন্দকার ও খরতৈল এলাকার সফি। পরে টঙ্গীর পার্শ্ববর্তী সাইনবোর্ড এলাকার ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের ওপর কৌশলে তাকে হত্যার পর হত্যাকান্ডে নিছক সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় টঙ্গী মডেল থানায় নিহতের স্ত্রী নাজমা সিকদার বাদী হয়ে অভিযোগ করলে থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর উপরোক্ত দুজনকে আসামি করে গাজীপুর জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিআর মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে স্থানীয় থানা পুলিশ বাদিনীর অভিযোগটি ৮ অক্টোবর গ্রহণ করে মামলা রুজু করেন। এ ঘটনায় টঙ্গী থানা পুলিশ মামলার বিবাদী সফিকুল ইসলাম ওরফে স্বপন খন্দকারকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। এদিকে মামলাটি চলমান অবস্থায় আওলাদ হোসেনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বলে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেশ করেন। অপরদিকে জয়দেবপুর সদর থানার এসআই মুঞ্জু ৩০ সেপ্টেম্বর জয়দেবপুর সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করলে নাজমা শিকদার মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তরের পরে এ বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতে নারাজি পেশ করেন। পরে আদালত ৩০ অক্টোবর কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে পুনরায় ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন মাস ১৮ দিন পর আওলাদের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ফের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তে খুন বলেই প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সিআইডি তাদের তদন্ত শুরু করে প্রথম থেকে। প্রথম সুরতহাল রিপোর্টে সিআইডি কর্মকর্তা চোখ বুলিয়ে নেয়। একটি স্থানে চোখ আটকে যায়। আওলাদের লাশের মুষ্টিবদ্ধ হাতে ঘাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়, তাকে হত্যার সময় নিশ্চয়ই বাঁচার চেষ্টা করেছেন। সামনে যা পেয়েছেন, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো ঘাস ছিল, সেটাই আঁকড়ে ধরেছিলেন আওলাদ। সিআইডি স্বপন আর শফিকে গ্রেফতার করে। জেরার মুখে তারা স্বীকার করে কীভাবে তারা আওলাদকে হত্যা করেছিল। তারা পুলিশকে বলে, ‘আওলাদের কাছে ৮ লাখ টাকা ছিল। সেটা আত্মসাৎ এবং সে কিছু টাকাও পেত। সেই টাকা না দেওয়ার জন্য তাকে হত্যার পরিকল্পনা করি। আওলাদকে মদের নেশায় মাতাল করে দেই। এরপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করি। সকালে লাশ পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যাই আওলাদের বাসায়। প্রচার করি, সে দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        