ঈদ, পূজা পার্বণ, পয়লা বৈশাখসহ যে কোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রতি তাদের রয়েছে আলাদা টান। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বাঙালি নারীর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। প্রতি বছরই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে যুক্ত হচ্ছে বৈচিত্র আর নতুনত্ব। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প গত বছর থেকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সামনের ঈদে তাঁতিরা নতুন উদ্যমে বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বুনন ও তা সারা দেশে সরবরাহ করতে ব্যস্ত। তাঁতের শাড়ির হাট-বাজার ও তাঁতপল্লীগুলো এখন কর্মমুখর। পাইকাররা ঈদে তাঁতের শাড়ি কিনতে ভিড় করছে দেশের বৃহত্তর করটিয়ার হাটে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী বাজিতপুর হাট ও পাথরাইল তাঁতপল্লীও সরগরম।
শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজা প্রধান মৌসুম। এবার পয়লা বৈশাখে তেমন শাড়ি বিক্রি হয়নি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার উৎসবের জন্য যেসব শাড়ি আগেই তৈরি করা ছিল সেগুলোই এখন বাজারের অপেক্ষায়।
বৈশাখের শাড়ি তৈরিতে ১০৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়িপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি হলে ৮ কোটি ৬ লাখ টাকার মতো লাভ হতো। গত দুর্গাপূজায়ও একই অবস্থা ছিল। বেচাবিক্রি হয়নি। এরপরও থেমে নেই তাঁতিদের প্রচেষ্টা। তারা নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি নিয়ে ঈদের মার্কেটে হাজির হতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।‘নদী, চর, খালবিল, গজারির বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গরবের ধন’- এ ঐতিহ্যের সঙ্গে টাঙ্গাইলের শাড়ির নাম জড়িয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে সেই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি জেলা-উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জেই তৈরি হয়। তবে তাঁতপল্লী নামে খ্যাত দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডী, মঙ্গলহোড়, নলশোঁধা, নলুয়া, বড়টিয়া, চিনাখোলা, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর, করটিয়া ও কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুরসহ প্রায় সব এলাকায়ই কাপড় বুননের কাজ হয়ে থাকে। এসব তাঁতশাড়ি ও তাঁতজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য পৌর এলাকার বাজিতপুর হাট ও করটিয়ার হাট বিখ্যাত। এছাড়াও তাঁতপল্লীগুলোতে ও শহরে রয়েছে তাঁতের শাড়ির শো-রুম। এসব হাট-বাজার ও শো-রুমগুলোতে প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি টাকার শাড়ি কেনাবেচা হয়। দেশের বৃহত্তম করটিয়ার হাটে প্রতি সপ্তাহে দুই দিন বুধ ও বৃহস্পতিবার তাঁতের শাড়ির হাট বসে। এখানে সারা দেশের পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা হাজির হয়।
টাঙ্গাইলের পাথরাইলের তাঁতপল্লীর কয়েক শ কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার কারিগর। ঈদকে সামনে রেখে তাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে দিনরাত অন্তত ১২ ঘণ্টা। তশর, এনডি, ডেনু সিল্ক, জামদানির ওপর চুমকির কাজসহ বাহারি ২০০টি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলোতে। এ কারণেই মূলত তাঁতপল্লী এখন উৎসবমুখর। টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ও চন্ডী, কালিহাতীর বল্লা ও রামপুরের তাঁতসমৃদ্ধ এলাকায় একই চিত্র দেখা যায়। ভোর না হতেই শুরু তাঁতের খটখটি শব্দ। রাতভর কাজ করেও তাঁতিদের ক্লান্তি নেই। প্রতিযোগিতা একটাই, উৎপাদন যত বেশি হবে, সাপ্তাহিক বিল তত বেশি পাবে। সুতা রং করা থেকে শুরু করে শাড়ি বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই পরিবারের সব বয়সের মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে নেমেছে নতুন শাড়ি। ভিন্ন বুটিক আর নতুন নকশায় তৈরি এই শাড়ি শুধু ঈদ উৎসবের জন্য। দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতের শাড়ির হাট টাঙ্গাইলের করটিয়া ঘুরে দেখা যায়, তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত কাপড় নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। স্থানীয় ও দূর থেকে আসা অধিকাংশ ক্রেতার চাহিদাই তাঁতের শাড়ি। মূল্যসীমাও হাতের নাগালে রয়েছে সুতি শাড়ির। এছাড়া সিল্ক, সপসিল্ক, রেশম ও দুতারের মধ্যেও রয়েছে উন্নতমানের শাড়ি।
টাঙ্গাইল শাড়ি ও বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, ছোট ঈদের সময় শাড়ি বিক্রি বেশি হয়ে থাকে। আমরা ও কারিগররা বছরজুড়ে প্রস্তুতি নিতে থাকি এই সময়ের জন্য। গত বছর করোনার কারণে আমরা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, ঈদে ব্যবসা করতে পারিনি। এবার প্রস্তুতি নিতে ছিলাম রোজার ঈদে ব্যবসা করে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় করোনার থাবায় তা তছনছ হয়ে গেছে। সরকারি প্রণোদনা পেয়ে তাঁতশিল্পীরা ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ঈদের শেষ মুহুর্তে বলব যেহেতু আমরা তাঁতের শাড়ি বিদেশে রপ্তানি করতে পারছি না, তাই দেশের সব মানুষের প্রতি আমাদের অনুরোধ, দেশীয় পণ্য তাঁতের শাড়ি কিনে আমাদের ও দেশের সহযোগিতা করবেন।
টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব হোসেন জানান, করোনায় টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বছরে দুইটি ঈদ, পয়লা বৈশাখ ও পূজার সময় আমাদের তাঁতশাড়ি বেশি বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা ঈদের সময়ের বিক্রি দিয়ে অন্য সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। আমরা এবারের ঈদে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।