মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ব্যাংকের নামে ভয়ংকর প্রতারণা

চক্রটি হাতিয়েছে কোটি কোটি টাকা দেশব্যাপী ৫০ ব্রাঞ্চ

সাখাওয়াত কাওসার

মাইনুল হোসেন, বাড়ি রাজশাহীর তানোরে। শিক্ষিত যুবক, বেশ কয়েক বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরছিলেন। একসময় জানতে পারেন বাড়ির পাশেই একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ খুলছে, নাম এসটিসি ব্যাংক। কয়েকজন এসে জানাল, স্থানীয় লোককে অগ্রাধিকার দেবেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ৫ লাখ টাকা জামানত ও ২ লাখ টাকা ঘুষ দিলে চাকরি কনফার্ম। ব্যাংকের নাম শুনে কোনো কিছু যাচাই করারও প্রয়োজনবোধ করেননি যুবক। এরিয়া ম্যানেজার আজিম উদ্দীন প্রামাণিক ও ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রানা রহমান মৃধা পাশের বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা। তাদের কথার ওপরই জমি বন্ধক রেখে ৭ লাখ টাকা তুলে দেন মাইনুল। বিপরীতে তাকে দেওয়া হয় নিয়োগপত্র। এক মাসের মধ্যেই তানোর বাজারে ব্যাংকের ব্রাঞ্চও উদ্বোধন হয়। ভালোভাবেই চলছিল তিন মাস। এর পরই হঠাৎ উধাও ব্রাঞ্চ ম্যানেজারসহ অন্যরা। মাইনুলের মতো আরেক ভুক্তভোগী আসমানি খাতুন। ডিগ্রি পাস করে রাজশাহী কলেজে মাস্টার্স করছিলেন। তার দেবর সোহেল রানাও এসটিসি ব্যাংকে এরই মধ্যে যোগদান করেছেন। দেবরের কথায় তিনিও জমি ও মায়ের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা তুলে দেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার রানা রহমান মৃধা ও চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের হাতে। ২০১৯ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার মালিবাগের লিলি প্লাজায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের কাছ থেকে নিয়োগপত্র নেন। আশ্বস্ত হন মাসিক বেতন ও টাকা জমা রাখার ফিক্সড ডিপোজিটের লভ্যাংশ পাওয়ার ব্যাপারে। তবে বিধিবাম! মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকের কার্যক্রম। উধাও হয়ে যান ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। শুধু মাইনুল এবং আসমানি নন, ওই ব্রাঞ্চেই এমন ১০ জনের কাছ থেকে অর্ধ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় এ চক্র। আর তানোরের মতো রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৫০টি ব্রাঞ্চ খুলে এভাবেই সহজ-সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে এ চক্র হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ৩০ কোটি টাকা।

ব্যাংক নয়, নেই ব্যাংকিং লাইসেন্সও। তার পরও অবৈধভাবে ব্যাংক শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাংকের মতোই আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। মানুষের সরলতা ও বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন শাখার ম্যানেজার, এরিয়া ম্যানেজার, সহকারী অ্যাডমিনসহ বিভিন্ন পদে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণামূলকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক তথা ‘এসটিসি ব্যাংক’ নামক এক ধরনের সমবায় সমিতি।

কয়েক মাস ধরে রাজধানীর মালিবাগে কথিত এসটিসি ব্যাংকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন অনেক ভুক্তভোগী। তবে তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিল প্রতারক সিন্ডিকেট। তারা কেউই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমান ওরফে বিপুল (৫৫) কিংবা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার দেখা পাচ্ছিলেন না। গতকাল সকালেও সেখানে জড়ো হন অন্তত ২০ জন ভুক্তভোগী। প্রতারণার এ বিষয়টি অবগত হয়ে সেখানে হানা দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার মিশু বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি দল। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমান ওরফে বিপুল ও ভাইস চেয়ারম্যান খালিদ হাসান লিটু ওরফে লিটু আনামকে (৫৪) তারা আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। তবে এর আগেই মালিবাগে লিলি প্লাজায় তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা দাবি করছিলেন, সমবায় অধিদফতরের অনুমতি নিয়েই তারা ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ১৯৭৬ সাল থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে এসটিসির মতো অন্তত আরও তিনটি ও কো-অপারেটিভ সমবায় সমিতির নামে শতাধিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। তার চেয়েও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রতারণা। জানা গেছে, সমবায় সমিতি আইন, ২০০১-এর ২৩-এর খ ধারায় বলা আছে- কোনো সমবায় সমিতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি এ ধারার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ডিবি রমনা বিভাগের উপকমিশনার এ এইচ এম আজিমুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অন্তত ১৫টি অভিযোগ পেয়েই আমরা এসেছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারে না। এজন্য সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। আবার এসটিসি সবকিছুই লঙ্ঘন করে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। এ প্রতারক চক্রের সহযোগী অন্য আসামিদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই এ দুজন বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এর নেপথ্য মদদদাতাদেরও খুঁজে বের করা হবে।’ গোয়েন্দাসূত্র জানান, ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে এসটিসি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, ওয়েবসাইট খুলে, এফডিআর-রসিদ, জমা বই, চেকবই ছাপিয়ে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে তারা এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছেন। এরা একজন ভুক্তভোগীর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই-বাছাই না করেই তার কাছ থেকে প্রথমে এফডিআরের জন্য ৫ লাখ এবং অফিসের খরচ বাবদ ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্র দিয়ে বিভিন্ন শাখায় যোগদান করতে বলেন। পরে শাখা বন্ধ হয়ে গেলে ভুক্তভোগী টাকা চাইতে গেলে তাকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করা হয়। এরই মধ্যে কৃষ্ণ সরকার নামে একজন ভুক্তভোগী রবিবার রমনা মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন।

 

সর্বশেষ খবর