‘খেলা জইম্যা ওঠছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিল্যা গেছে। রুমিন ফারহানা কী কইছে হোনছেন? বিএনপিই টেনশনে পইড়া গেছে। হেরাই এহন আওয়ামী লীগরে চায়।’
গত সোমবার বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন পাঠাও চালক (রাইড শেয়ার) লুৎফর রহমান। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ফেক ভিডিওর ভিত্তিতে তার এমন বক্তব্য।
অনুসন্ধান করে টিকটকে পাওয়া যায় ভিডিওটি। ‘খেলা জমেছে এবার, শেখ হাসিনার কর্মীরা সাড়া দাও’- শিরোনামের ওই ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিওতে রুমিন ফারহানাকে বলতে শোনা যায়, ‘শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে যা করণীয় দরকার তাই করতে হবে। শেখ হাসিনার যদি অস্তিত্ব না থাকে, যদি আওয়ামী লীগ না আসে তাহলে কিন্তু এই দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। আমরা রক্ত চাই না, আমরা শান্তি চাই।’
কণ্ঠটি হুবহু রুমিন ফারহানার মনে হলেও ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার ভিডিওটি পর্যালোচনা করে পেয়েছে ভিন্ন তথ্য। প্রযুক্তির মাধ্যমে রুমিন ফারহানার কণ্ঠ নকল করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। মূল ভিডিওটি ছিল ২০২৩ সালের, যেখানে রুমিন ফারহানা অন্য বিষয়ে কথা বলছিলেন।
রাজনীতির মাঠের দখল নিতে অপতথ্যের এই সাইবার যুদ্ধ এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গুজবের লক্ষ্যবস্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তি, অন্তর্বর্তী সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কখনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বেশি গুজব ছড়ালেও বর্তমানে রাজনীতির পাশাপাশি বাড়ছে ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে গুজব। ভুয়া খবরগুলোই আবার চায়ের দোকান হয়ে বাসার রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এসব গুজব রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি উসকে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে ভূমিকা রেখেছে এসব অপতথ্য। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার (এক্স) ছাড়াও দেশি-বিদেশি কিছু গণমাধ্যমেও ছড়ানো হচ্ছে এমন অপতথ্য। সম্প্রতি ‘সামরিক শাসন জারি করলেন সেনাপ্রধান, কেড়ে নিলেন ইউনূসের নোবেল’, ‘মারা গেছেন শেখ হাসিনা’, ‘বিদেশে ওবায়দুল কাদেরের মৃত্যু’, ‘ড. ইউনূসসহ ২০ উপদেষ্টাকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা’, ‘নাগরিক কমিটির নেতা সারজিস আলমকে গ্রেপ্তার’, ‘নায়িকা পূজা চেরী ছাত্রশিবিরের অমুসলিম শাখায় যোগ দিয়েছেন।’- এমন অসংখ্য অপতথ্যে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া। বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এগুলো গুজব প্রমাণিত হলেও অনেকেই এগুলো বিশ্বাস করছেন। বিভিন্ন আড্ডায়-আসরে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছে, গত ১১ মাসের ধর্ম বিষয়ে ৩১৩টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৫১ শতাংশই প্রকাশিত হয়েছে গত চার মাসে। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ধর্মীয় অপতথ্যগুলো ছিল ধর্মীয় মহিমা প্রচার, ধর্মান্তর ও অলৌকিকতা নিয়ে। আগস্ট থেকে ধর্মীয় অপতথ্যের জায়গা দখল করেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষ। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা মোট ৯১৭টি স্বতন্ত্র ভুল তথ্য যাচাই করে দেখে- এর মধ্যে রাজনৈতিক ভুল তথ্য ছিল সবচেয়ে বেশি (৪২ ভাগ)। আগের তিন মাসের তুলনায় যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
অপতথ্য রুখতে সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপতথ্য প্রতিহত করতে আমরা মাল্টিপল ব্যবস্থা নিয়েছি। বাংলাদেশি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তারা সঠিক তথ্য সামনে আনছে। সমস্যা হচ্ছে একটা গুজব যত তাড়াতাড়ি ছড়ায়, সেটা প্রশমিত করতে আট গুণ বেশি সময় লাগে।