সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই ভূমিকম্পের সঙ্গে মানুষের পরিচয়। এই ভূমিকম্পই তৈরি করেছে সাগর-মহাসাগর, পর্বত, ভূখণ্ড। ভূমিকম্প যেমন নিমিষেই বদলে দিতে পারে কোন ভূখণ্ডের ভৌগলিক চিত্র, তেমনি লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পের প্রবণতা হঠাৎই যেন বেড়ে গেছে। নেপালে হয়ে গেল শতাব্দির ভয়াবহ ভূমিকম্প। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যেই আফটার শক মিলে সারাবিশ্বে ভূমিকম্পের সংখ্যা কয়েক ডজন। হাজার হাজার মানুষ ইট-কাঠ-পাথর চাপায় প্রাণ হারিয়েছেন। পরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি ভূমিকম্প বিষয়ে জনসচেতনতা থাকলে নেপালে ক্ষতি হয়ত আরেকটু কম হতে পারত। বাংলাদেশও ভূমিকম্প ঝুঁকিবহুল অঞ্চলে অবস্থিত। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এখানে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এমন একটা ভূমিকম্প বয়ে আনতে পারে মহাবিপর্যয়। তাই ভবনগুলো যেহেতু রাতারাতি ভেঙে ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি করা যাবে না তাই জনসচেতনতা ও কিছু পূর্ব প্রস্তুতি ক্ষতির আশঙ্কা কিছুটা লাঘব করতে পারে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প টের পেলেই মানুষ দৌঁড়ে বাইরে চলে যায়। নেমে আসে রাস্তায়। হয়ত মনে করা হয় বিল্ডিং লম্বালম্বিভাবে ধ্বসে পড়বে, সুন্দরভাবে এক ফ্লোরের উপর আরেক ফ্লোর স্তরে স্তরে, আর বিল্ডিংয়ের পাশেই রাস্তাটা থাকবে ঝকঝকে। বাস্তবা কিন্তু ভিন্ন। ঢাকা শহরের মতো ঘন জনবসতি আর দালানে-পিলারে-সাইনবোর্ডে-ইলেকট্রিক তারে ঘিঞ্জি একটা জায়াগায় ভূমিকম্পের সময় বাইরে বের হওয়া মানে মোটামুটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। নেপালের দিকে তাকালেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। সেখানে রাস্তার দু'পাশে বিল্ডিংয়ের কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে, শুধু দেয়ালগুলো ভেঙে গিয়ে সব ইট, কাঠ, কংক্রিট আর কাঁচের টুকরো রাস্তায় স্তুপ হয়ে আছে। অর্থাৎ ওই বিল্ডিংয়ের কোন পিলার ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে রাস্তাটা ছিল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
কিছু বিল্ডিং হেলে গেছে, ওগুলো থেকে ভেঙে পড়া ইটপাথরও আশপাশের রাস্তায় জমেছে। ওগুলো সব পড়ার সময় উঁচু দালান থেকে ছিটকে পড়েছে, যা বিল্ডিংয়ের নিচে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অনেক মানুষ হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে মারা পড়েছেন। তাই ভূমিকম্প টের পেলে সবার আগে ঠাণ্ডা মাথায় করণীয় ঠিক করুন।
ভূমিকম্পের সময় যা করবেন:
১. ভূমিকম্প টের পেলে সবার আগে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন যে, আপনার গায়ে যাতে কিছু এসে না পড়ে। ভূমিকম্পের সময় আপনি যে দালানটিতে আছেন, সেটা যদি ভেঙেই পড়ে, তবে তারও আগে আপনার ফ্লোরের ওপর শোকেস, টিভি, হাঁড়ি-পাতিল, প্লেটসহ অন্যান্য সব ভারী ভারী জিনিস পড়তে থাকবে। কাজেই আপনার প্রথম কাজ হলো, এসবের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা, বিশেষ করে মাথাটাকে। এ সময় ডাইনিং টেবিল বা খাটের নিচে ঢুকে পড়তে পারেন।
২. ভূমিকম্পের সময় ভবনের ত্রিকোনাকার স্থানগুলোতে আশ্রয় নিন। সাধারণত পিলারের কাছেই এ জায়গাগুলো থাকে। আর এটা ওই ভবনের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ভবন ভেঙে পড়লেও অনেক সময় কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আপনি তুলনামুলক নিরাপদে থাকবেন। আর বিল্ডিং হেলে পড়ুক আর ধ্বসে পড়ুক, এই ত্রিকোনাকার স্পেসটা পরবর্তিতে আপনার উদ্ধার হবার সম্ভাবনাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
৩. ভূমিকম্প হলে সবাই মিলে কোথায় ঢুকবেন সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। বড় ডাইনিং টেবিল থাকলে সেটার নিচেই সবচেয়ে ভালো। উঁচু খাট থাকলে সেটাও খুব ভালো, বিশেষ করে ম্যাট্রেস (চাপ শোষন করবে) আর শক্ত পাটাতন থাকলে তো কথাই নেই।
৩. সবসময় ভূমিকম্প সারভাইবাল কিট -- মিনিমাম, একটা টর্চ লাইট, দুই পাউন্ড টোস্ট বিস্কিট আর এক বোতল পানি আশ্রয় নেওয়ার জন্য ঠিক করে রাখা নির্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি রাখুন। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে এগুলো কাজে দেবে।
৪. বড় ভূমিকম্প একবার হয়েই শেষ না, কয়েকদিন ধরে বারবার হয়। মাঝে মাঝে আফটার শক মূল ভূমিকম্পের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। কাজেই একবার বড় ভুমিকম্প হলে পরের কয়েক রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে একটা কাঁথা রাখুন, সময়মতো সবচেয়ে জরুরি মাথাটাকে ঢেকে রাখুন।
বিডি-প্রতিদিন/০৮ মে ২০১৫/ এস আহমেদ