আজ ১৪ জুন। তেল-গ্যাস কোম্পানি অক্সিডেন্টালের অদক্ষতায় ১৭ বছর আগে এই দিনে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে ব্লো আউট হয়ে গিয়েছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকার গ্যাস। ওইদিনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, রেলপথ, মৌলভীবাজার স্ট্রাকচার, গ্যাস পাইপ লাইন, গ্যাসকূপ, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূগর্ভের পানিসম্পদ, রাস্তাঘাট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় ছোট বড় ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার আটশ ৩০ টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। তা ছাড়া বনাঞ্চলের ৬৯.৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ছয়শ ৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩.৬১ কোটি টাকা।
ওই দিনের ওই বিষ্ফোরণে শুধু দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিই হয়নি, পথে বসে যায় স্থানীয় অনেক পরিবার। গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। দুর্ঘটনার ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত দাবিকৃত ক্ষতিপূরণের পুরো অর্থ পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। ক্ষতিগ্রস্ত খাসিয়া পুঞ্জির লোকজন কিছু নগদ অর্থ পেলেও সিংহভাগ অর্থ লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়।
এরই মধ্যে মাগুরছড়া গ্যাসকূপের শেয়ার তিনবার হাতবদল হয়েছে। বিস্ফোরণের পর থেকে এ কূপটি সিলগালা করে রাখা হলেও মাটির নিচ দিয়ে পাইপ লাইন বসিয়ে কালাছড়া কূপ দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কৌশলে। মাগুরছড়া কূপটি ফুলবাড়ি চা বাগানের পাশে এবং শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত। শেভরন কর্তৃপক্ষ মাগুরছড়া কূপ থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে কালাপুর গ্যাসক্ষেত্রে লাইন টেনে নিয়েছে। এ লাইন প্রতিদিন গ্যাস তুলছে শেভরন।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ খননকালে বিস্ফোরণে কূপে আগুন লাগে। তৎকালীন মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনাই বিস্ফোরণের প্রধান কারণ বলে দাবি করেন তৎকালীন তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণের ব্লো-আউটে ক্ষতি হয় দুইশ ৪৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস। বিস্ফোরণের পর আগুনের তাপ কিছুটা কমে এলেও তৎকালীন মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানির লোকজন বিস্ফোরিত কূপের মুখ সিলগালা করে দেয়। এরপর হাতবদল হয়ে অক্সিডেন্টাল থেকে ইউনোকল মাগুরছড়ার দায়িত্ব নেয় এবং ২০০৬ সালে ইউনোকল থেকে শেভরন কর্তৃপক্ষ সব শেয়ার কিনে নেয়। বর্তমানে এ অঞ্চলে মাগুরছড়া, কালাছড়া ও জাগছড়া কূপে সব ধরনের কাজ করছে শেভরন।
শেভরণ কর্তৃপক্ষ স্থান বদল করে গ্যাস উত্তোলণের কাজ চালিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে চলছে।
২০০৩ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনোকলের কাছে গ্যাসের ক্ষতির জন্য তিন হাজার ৯শ’ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এ ছাড়া পরিবেশের ক্ষতির জন্য ৮৪ কোটি টাকাও তাদের কাছে দাবি করা হয়। কিন্তু ইউনোকল ১৪ নম্বর ব্লক নিয়ে সম্পূরক চুক্তির মাধ্যমে এ ক্ষতিপূরণের সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করে। এরপর ইউনোকল এবং পরে শেভরন তিন হাজার ৯শ’ কোটি টাকা আর দেয়নি।
জানা যায়, বিষ্ফোরণের পরপরই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক মাসের মধ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ড. তৌফিক ই ইলাহীর কাছে দুইটি ভলিয়মে পাঁচশ’ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও বিতরণের বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলামকে আহবায়ক করে ৩ সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন অভিমত প্রকাশ করেন তদন্ত কমিটির সদস্যবৃন্দ।
১৯৯৭-২০০৬ সময়কালের সরকার মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ রহস্যজনক কারণে এসব মার্কিন কোম্পানি থেকে আদায় করেনি।