ধর্ম ও ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিকৃতি এবং এর প্রভাব অনেকের অজানা নয়। শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, ইতিহাস, বিশেষ করে ইসলামী ইতিহাস দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধরনের বিকৃতির শিকার হয়েছে। এর পেছনে যেমন কিছু পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা আছে, তেমনি অমুসলিম আরব লেখকদেরও একটি অংশ এতে ভূমিকা রেখেছে। তারা অনেক সময় সচেতনভাবেই ইসলামী ইতিহাসের ধারাকে আঘাত করেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে, যদিও এর প্রভাব তেমন প্রতিফলিত হয়নি।
অন্যদিকে কিছু মুসলিম ইতিহাসবিদ ও তাফসিরকারক যেমন—ইমাম তাবারি, কুরতুবি, ইবনে কাসির, ইবনে আসির প্রমুখ যাঁরা সাধারণভাবে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপনেই বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁরাও ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইহুদি বর্ণনা ও তথাকথিত ‘ইসরায়েলিয়াত’ বর্ণনার প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারেননি। অথচ ইহুদিরা তাদের নিজস্ব মত ও কল্পিত ঘটনা বিভিন্ন সূত্রে লিপিবদ্ধ করে ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেসব বর্ণনা বহু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এক নতুন প্রজন্মের লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ আমাদের সামনে আবির্ভূত হন। তাঁরা ইসলামের ইতিহাসে অনুপ্রবেশ করা বিকৃতি ও ইসরায়েলিয়াতভিত্তিক তথ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন।
তবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া মূলত সীমাবদ্ধ ছিল গবেষণা নিবন্ধ, একাডেমিক আলোচনাচক্র, সেমিনার ও সম্মেলনের পরিসরে, যা সাধারণ পাঠকের নাগালের বাইরে ছিল। ফলে ইতিহাসপ্রেমী সাধারণ পাঠক, যারা বিশেষজ্ঞ না হয়েও ইসলামী ইতিহাসে আগ্রহী, তারা সেই বিকৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারেনি। অথচ এই পাঠক সমাজ থেকেই পরবর্তী সময়ে অনেক লেখক ও চিন্তাবিদ গড়ে ওঠেন, যাঁদের একটি শ্রেণি সংবাদপত্র ও জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকায় লিখতেন। তাঁদের লেখার মাধ্যমে একটি বৃহৎ পাঠকগোষ্ঠী ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এরপর সেই লেখকদের পরবর্তী স্তরে দেখা যায় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতাদের আবির্ভাব, যাঁরা ইতিহাসকে গল্পের ছকে সাজিয়ে জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করতে শুরু করেন। এই লেখকদের লেখা মিডিয়াজগতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকরা তাঁদের খোঁজ করতে শুরু করেন, কারণ ইতিহাস এখন শুধু পাণ্ডিত্যের বিষয় নয়, জনমানসের চিন্তার অংশও হয়ে উঠছে। যেহেতু নাটকীয় উপস্থাপনায় দর্শক বা পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখতে নানা রকম ‘মসলা’ প্রয়োজন হয়, তাই বহু ক্ষেত্রে প্রেম, আবেগ ও রোমান্সের উপাদানকে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয় এমন সব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, যার প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে এই উপাদানগুলোর কোনো সম্পর্কই নেই। ফলে এসব কাল্পনিক আবেগের ছোঁয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনার মূল তাৎপর্য ও মহৎ উদ্দেশ্য ধ্বংস হয়ে যায়।
বিষয়টি এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে আজকাল প্রায় কোনো ঐতিহাসিক কাহিনি, নাটক বা ধারাবাহিক গল্প এসব নাটকীয় উপাদান ছাড়াই উপস্থাপিত হয় না। এক পর্যায়ে বিষয়টি এমন বিকৃত রূপ নেয় যে ইসলামের বিজয়গাথাও প্রেম ও রোমান্সের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা হয়, এমনকি কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে যে ইসলামের প্রসারের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল প্রেমঘটিত সম্পর্ক বা রোমান্টিক আবেগ! এমন বানোয়াট ব্যাখ্যা ইতিহাসের পবিত্রতা ও সত্যনিষ্ঠাকে শুধু আঘাতই করে না, বরং সাধারণ মানুষের মানসে বিকৃত ইতিহাসের একটি ভিত্তি তৈরি করে দেয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।
পরিতাপের বিষয় হলো, রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিদের নিয়েও ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ঘৃণ্য প্রবণতার অনুসরণ করা হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি ঐতিহ্যের কিছু বিকৃত বর্ণনা ইসলামী ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এই ধারা থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসুলরা সম্পূর্ণভাবে রেহাই পাননি। ইসরায়েলি বর্ণনায় দাউদ (আ.)-এর সম্পর্কে যেসব গল্প প্রচলিত আছে, তা তারই একটি দৃষ্টান্ত। এসব ইসরায়েলি উপকথা একসময় এমনভাবে প্রচার পায় যে সেগুলো কোরআনের কিছু আয়াতের পটভূমি বা প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যার অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। প্রাচ্যবিদদের একটি অংশ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে এসব বিকৃত ইতিহাস ও ব্যাখ্যা প্রসার ঘটায়, যা কখনো কখনো পুরো ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফলে ইতিহাস শুধু বিকৃত হয় না, বরং পবিত্র চরিত্রগুলো সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ধারণাও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই একসময় ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস, ইসলামী বিজয় ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রতীকগুলোকে বিকৃত করা হতে থাকে। এমনকি যাঁরা ইসলামী ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা ছিলেন—এক বছর বিজয় অর্জন করেছেন, আর পরের বছর হজ পালন করেছেন—তাঁদের চরিত্র ঘিরেও মিথ্যা ও অবমাননাকর গল্প ছড়ানো হয়েছে। এসব বর্ণনায় বিনোদন, ভোগবিলাস ও মদপানের কল্পিত কাহিনি জুড়ে দেওয়া হয়। প্রাচ্যবিদদের ব্যাখ্যায় ‘হারেম/হেরেম’ শব্দটি এমনভাবে জনপ্রিয় করা হয়েছে, যেন তা ইসলামী সমাজের স্বাভাবিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। অথচ বাস্তবতা ছিল এর ব্যতিক্রম।
এসব বিকৃতি শুধু ইসলামী ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মুসলিম জ্ঞান ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বহু প্রজন্ম ধরে এই বিকৃত তথ্য ও ব্যাখ্যার ছায়া মুসলিম মানসে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে, এমনকি বর্তমান সময়েও অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ ও লেখক এই বিকৃতির প্রতিফলে গড়ে ওঠা ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজন আরো গভীর ও নিরপেক্ষ পঠন ও পর্যবেক্ষণ—যেখানে ইতিহাসকে আবেগ নয়, যুক্তি ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণ করা হবে। সত্যকে সত্যের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরপেক্ষতা হবে মুখ্যনীতি। বিকৃতি নয়, বস্তুনিষ্ঠতাই হবে ইসলামী ইতিহাসচর্চার মূলমন্ত্র। যেখানে ইতিহাসের যেসব ঘটনা উচ্চমাত্রার বিকৃতির শিকার হয়েছে, সেগুলোর সুস্পষ্ট উদাহরণ তুলে ধরতে হবে, যাতে পাঠকের মন জাগ্রত হয় এবং সত্য ইতিহাসের অনুসন্ধানে ফিরে আসতে পারে।
(আলুকাহ ডটনেটে প্রকাশিত সৌদি আরবের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড. আলী বিন ইবরাহিম আন-নামলার ইতিহাস বিষয়ে একটি প্রবন্ধের অনুবাদ)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন