নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ। গতকাল রাতে উত্তর চব্বিশ পরগনার বিমানবন্দরসংলগ্ন কৈখালী এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। নূর হোসেন ছাড়া গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন কারওয়ান বাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিকুল ইসলাম ওরফে আশিক, মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের অন্যতম সহযোগী সন্ত্রাসী গাজী সুমন, নারায়ণগঞ্জের শামীম ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে। অন্য একজনের পরিচয় জানা যায়নি। ওই বাড়িতে নূর হোসেনসহ অন্যরা আত্মগোপন করে ছিলেন।
রাজ্য পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতার নূর হোসেনসহ সব আসামিকে আজ বারাসাত জেলা সদর আদালতে তোলা হবে। আশিক ও গাজী সুমন দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা থেকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তারা।এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নূর হোসেন খুব শীঘ্রই গ্রেফতার হবেন এমন খবর আমাদের কাছে ছিল। তবে আজ (গতকাল) রাতেই যে গ্রেফতার হয়েছেন এ বিষয়ে আমি এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।’হত্যা মামলায় নূর হোসেনের নাম আসার পরই তাকে ধরতে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, যশোর, বেনাপোল, ফেনী ও কুমিল্লা সীমান্ত এলাকাসহ বেশ কয়েক স্থানে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। তবে শোনা যাচ্ছিল তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছিলেন নূর হোসেন ঢাকায়ই একজন প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিরাপদে আছেন। কারও মতে, ভারত হয়ে দুবাই, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে পারেন তিনি। তবে ভারতে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র জানিয়েছিল, নূর হোসেন কলকাতায় নেই। তিনি পঞ্চম স্ত্রী রুমাকে নিয়ে হিমাচল প্রদেশের সিমলা শহরে অবকাশ যাপন কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের পরও দুই দিন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জেই ঘুরে বেড়িয়েছেন নূর হোসেন। প্রশাসনের বন্ধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যথারীতি আড্ডা দিয়েছেন। তার নাচ-গান-মাদকের আসরও বন্ধ ছিল না। কিন্তু শীতলক্ষ্যায় একের পর এক লাশ উদ্ধার হতেই গাঢাকা দেন নূর। এর পরও তার অবস্থান ছিল রাজধানীর ধানমন্ডি ও গুলশানে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণে ধানমন্ডিতে নূর হোসেনের অবস্থান চিহ্নিত হয়। তার টেলি কথোপকথন রেকর্ড করা সম্ভব হলেও তখন তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। এর পরই ‘হাওয়া’ হয়ে যান নূর হোসেন।
তারেক সাঈদ ফের রিমান্ডে : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় র্যাব-১১-এর সাবেক সিও লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে ষষ্ঠ দফায় আরও চার দিনের পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিমকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে তারেক সাঈদকে গতকাল বিকালে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে আনা হয়। আদালত শুনানি শেষে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বিকাল সোয়া ৫টায় বরাবরের মতোই কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তারেক সাঈদকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশীদ মণ্ডল আসামির সঙ্গে প্রেরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, তারেক সাঈদের কাছ থেকে ৭ হত্যার ঘটনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাইবাছাই এবং আরও তথ্য সংগ্রহে আসামিকে আরও সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। রিমান্ড শুনানিতে আদালতের কোর্ট সিএসআইআই আশরাফ তার বক্তব্যে তারেককে আবারও রিমান্ডে নেওয়ার যুক্তিকতা তুলে ধরে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সাত খুন মামলায় তদন্তে ৮০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। তারেক সাঈদের নির্দেশেই সাত খুন সংঘটিত হয়েছে। সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের সঙ্গে তারেক সাঈদের অপরাধমূলক সম্পর্ক ছিল। মাদক ও চিটাগাং রোডের বাস থেকে তারা চাঁদা উত্তোলন করত। খুনের জন্য নূর হোসেনের কাছ থেকে সে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছে।
রিমান্ড শুনানিতে অংশ নিয়ে, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, সাত খুন করতে যে টাকা ইনভেস্ট হয়েছে তার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিছু টাকা উদ্ধার হয়েছে। কে টাকা দিয়েছে কারা টাকা নিয়েছে সব কিছু তদন্তে বের হয়ে এসেছে। এদিকে তারেক সাঈদ তার বক্তব্যে বলেছেন, আমি এর আগে আদালতে বক্তব্য দিয়েছি। তাই আমার কিছু বলার নেই। আদালতে তারেক হাস্যোজ্জ্বল ছিল।
নূর হোসেন জড়িত : নূর হোসেনের প্রধান দেহরক্ষী মোর্তুজা জামান চার্চিল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। গতকাল নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিন তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। এরপর আদালতের নির্দেশে তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। চার্চিলের জবানবন্দিতে সাত খুনের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নূর হোসেনের সম্পৃক্ত থাকার কথা উঠে এসেছে। চার্চিল তার জবানবন্দিতে খুনের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে লাশ ফেলা পর্যন্ত কারা জড়িত, কার কী দায়িত্ব ছিল এবং ওই ঘটনায় তার কী দায়িত্ব ছিল তার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরে।
মূলত ঘটনার দিন চার্চিলের নেতৃত্বে অন্য একটি হাইএস মাইক্রোবাসে ৮-১০ জনের একটি টিম ছিল র্যাবের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য। এই টিমটি পরে সাতজনকে হত্যার পর লাশ গুমের জন্য প্রক্রিয়াজাত এবং লাশ ফেলার কাজে র্যাব সদস্যদের সহযোগিতা করে। চার্চিলসহ সাত খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।চার্চিলের আগে র্যাব-১১-এর সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন এবং র্যাব-১১-এর ক্রাইম প্রিভেনশন স্পেশাল কোম্পানির অধিনায়ক লে. কমান্ডার এম এম রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ দুই কর্মকর্তার জবানবন্দিতেও ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নূর হোসেনের নাম উঠে এসেছিল। এবার নূর হোসেনের প্রধান দেহরক্ষী মোর্তুজা জামান চার্চিলের জবানবন্দিতেও উঠে এলো ঘটনার নেপথ্যে ছিল নূর হোসেনই।