বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের গহীন অরণ্যে এবারও ধরিয়ে দেয়া নাশকতার আগুন ৩১ ঘণ্টায়ও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বুধবার সকালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের আড়ুয়ার খাল সংলগ্ন তুলাতলা-টেংরার বিল এলাকার ২৫ নম্বার কম্পার্টমেন্টে ধরিয়ে দেয়া আগুন এখন থেকে-থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
সুন্দরবন বিভাগ বুধবার সন্ধ্যা থেকে আগুন যাতে করে গোটা বনে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ফায়ার লাইন ( অগভীর নালা কেটে পানি ভরে দেয়া) কাটার কাজ শুরু করলেও ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট রাত ৮টার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিযানে নামে। ফায়ার সার্ভিসের বাগেরহাট, শরণখোলা, মংলা ও মোড়েলগঞ্জের ৪টি ইউনিট বাঘের ভয়কে উপেক্ষা করে সারা রাত ধরে আগুন নেভাতে থাকেও বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। আগুন বিভিন্ন স্থানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আবার তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। ইতোমধ্যেই পুড়ে গেছে কয়েক একর বনভূমি। দুর্ঘটনাস্থলে থাকা বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি মানিকুজ্জামান দুপুরে এতথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, পরিকল্পিতভাবে কারা বনে ফের আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তাদের চিহ্ণিত করাসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ মো. বেলায়েত হোসেন প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম জানান, এবারের নাশকতার আগুনের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে তদন্ত কাজ শুরু করেছে।
ওদিকে, সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, গত এক মাসে ৪ বার আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণ হয়েছে, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা সুন্দরবন সুরক্ষায় আন্তরিক নয়। সুন্দরবনে শুধু অগ্নিকাণ্ডই নয়, প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ ধরা, বাঘ-হরিণ শিকার ও গাছ পাচারসহ নানা ধরণের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড চলছে যার অধিকাংশই দৃশ্যমান না হওয়ায় মিডিয়াতে আসছে না। যা সর্ম্পূণভাবে গোপন থাকছে। আর আগুন লাগার বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়াতে বারবার এটি মিডিয়াতে আসার পরও বন সন্নিহিত লোকালয় বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জের শাসকদলের কতিপয় জনপ্রতিনিধি এবং তাদের আশ্রিত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম আরও বলেন, সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থের বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ বনজুড়ে যা হচ্ছে সবই অবৈধ, বেআইনি ও পরিকল্পিত। তাই এই বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন সুরক্ষা এখন থেকেই সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা এবং কাজ করা প্রয়োজন। সুন্দরবন সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন সরকারের কাছে দাবি জানায়।
শরণখোলা উপজেলার স্থানীয় ধানসাগর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন লোকালয়ের ওয়াপদা বেড়িবাধের উপর দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, এখনো আগুনের কুণ্ডলি দেখে মনে হচ্ছে গত কয়েকবারের লাগা আগুনের চেয়ে এবার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধি আরও জানান, লোকালয় থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার গহীন অরণ্যে আবারও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সুন্দরবনের এক একটি বিল কথিত ইজারা নেয়ার নাম করে মাছ চাষ করা মৎস্যজীবীরা।
উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় সুন্দরবনের ১০ একর বনভূমি। ১২ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল এ দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১১ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে সুন্দরবন বিভাগ পরিকল্পিত নাশকতার আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে। মামলা হলেও শরণখোলা থানা পুলিশ আওয়ামী লীগের ওই ১১ নেতাকর্মীর একজনকেও আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি।
বিডি-প্রতিদিন/ ২৮ প্রতিদিন, ২০১৬/ রশিদা