রবিবার সকাল সাতটা। টঙ্গীর ধসে যাওয়া ভবনের মূল ফটকে নানার কোলে বসে আছে চার বছরের শিশুকন্যা ইকরা। অবুঝ চোখজোড়া ধ্বংসস্তুপে খুঁজে ফিরছে বাবাকে। এমন সময় মৃত বাবার পোড়া সাইকেল দেখে কচি হাতের আঙ্গুল তুলে চিৎকার করে ওঠে মেয়েটি- 'বাবা ওই...ওই...'।
কারখানার সামনেই আগুনে পুড়ে পড়ে আছে কারখানার সহযোগি অপারেটর ওয়াহিদুজ্জামান স্বপনের ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি। অবুঝ শিশুটির আকুতি দেখে নানাও কেঁদে উঠেন। নানার সাথে আশপাশে থাকা লোকজনও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। পুড়ে যাওয়া টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানার ধ্বংসস্তুপের আশপাশে ঘোরার সময় এমন অসংখ্য হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে।
গাজীপুর জেলা তথা টঙ্গী এলাকায় এত বড় ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এদিকে নানার কোলে থাকা অবুঝ শিশু তখনো জানে না তার বাবা আর নেই। কিংবা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
প্রতিদিন ওই সাইকেলে করে উত্তরাখান মুন্ডা এলাকার নিজ বাসা থেকে টঙ্গী ট্যাম্পাকো কারখানায় কাজে আসতেন স্বপন। গত শুক্রবার রাতেও তিনি কাজে এসেছিলেন। কিন্তু প্রতিদিনের মতো শনিবার সকালে আর বাড়ি ফিরে যাননি। এদিন ভোরে কাজ শেষে কারখানা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ আগমুহুর্তে হঠাৎ একটি বিটক শব্দ হয়। পরে কারখানায় আগুন লেগেছে এমন খবর শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানার অন্য শ্রমিদের সাথে স্বপনও দ্রুত সিড়ি বেয়ে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ধসে যাওয়া ভবনের ইট, কংক্রিট ও কাঁচের আঘাতে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢামেক হাসাপাতালে পাঠান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ১০টার দিকে তিনি মারা যান।
এ ঘটনার পর নিহত স্বপনের লাশ ময়না তদন্ত শেষে ওইদিনই স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে স্বপনের মরদেহ বাসায় নিয়ে আসার পর তার দুই বছর ও চার বছর বয়সী দুই অঝুঝ শিশু শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শিশু দুটি বুঝতেই পারেনি যে তাদের বাবা মারা গেছেন। এ সময় স্বপনের স্ত্রী ইতি হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একবার লাশের দিকে, আরেকবার অবুঝ দুই শিশু সন্তানের দিকে ছুটে যায়।
চিৎকার করে বলতে থাকেন, 'একি হলো, আমি এখন কি করব। এই শিশুদের নিয়ে কই যাব।' এসব বলতে বলতে তিনি বার বার মুর্ছা যান।
নিহত স্বপন সিরাজগঞ্জের ওয়াজেদ আলীর ছেলে। তিনি উত্তরাখান মুন্ডা এলাকায় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করে পাঁচ বছর যাবৎ টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানায় কাজ করে আসছিলেন। শুধু স্বপনের ভাগ্যেই এমটি ঘটেনি। এই কারখানায় কর্মরত ৩১ জনের ভাগ্যেও এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এ সময় কথা হয় স্বপনের শ্বশুরের সাথে। তিনি বলেন, শুক্রবার রাতে কারখানায় কাজ করতে আসে মেয়ের জামাতা। শনিবার সকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সে আহত হয়েছে এমন খবর পেয়ে কারখানায় দ্রুত ছুটে আসি। এরপর তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩০জন শোনা গেলেও এ সংখ্যা বেশি বলে ধারণা করছে কারখানার আশ পাশের বাসিন্দারা।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ