ঢাকাসহ সারা দেশের নগরগুলোতে দিন দিন বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। রয়েছে অসহনীয় যানজট। দুর্ঘটনা এড়াতে দেশে মটরযান আইন থাকলেও তা তোয়াক্কা করছে না অনেকে। জনসাধারণের সচেতনতার অভাব, চালকদের অসতর্কতা, অবহেলা, আইন-কানুন না জানা, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বহীনতা এবং আইন বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকাই এর মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন সংশিষ্টরা। একদিকে যেমন সাধারণ জনগন ট্রাফিক আইন মেনে চলছেন না ঠিক তেমনি তা অনুসরণ করছেন না চালকরাও। আবার ট্রাফিক পুলিশও সেই আইন বাস্তবায়নে সবর্দা সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুড়ে দেখা যায়, ফুট ওভার ব্রিজ থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন সাধারণ জনগন। ফলে অনেক সময়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এছাড়া লোকাল পরিবহনগুলো যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে। ফলে বিভিন্ন সড়কে গতি নির্ধারন করা থাকলেও তা অনুসরন করছেন না চালকরা। আবার যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামানোর কাজ করছেন চালক-হেলপার। ফলে বাড়ছে যানজট আর ভোগান্তি। এছাড়া ট্রাফিক আইন অমান্য করে উচ্চ স্বরে বাজাচ্ছেন গাড়ির হর্ণ। স্থান ভেদে শব্দ সীমা নির্ধারন করা থাকলেও তা তোয়াক্কা করছেন না চালকরা। ফলে বাড়ছে শব্দ দূষণ আর অতিষ্ঠ হচ্ছে নগরবাসী।
এছাড়া রাজধানীতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো নিত্তদিনের চিত্র। যাত্রী সংগ্রহে দুর্বার গতিতে ছুটে চলে লোকাল বাসগুলো। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাসগুলোর এমন বেপরোয়া গতির কারণে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এমনকি চোখের সামনে বাসগুলোর এমন প্রতিযোগিতা চললেও অনেক ক্ষেত্রেই নিরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশদের। এছাড়া রয়েছে ফিটনেস বিহীন লক্কর ঝক্কর গাড়ির ছড়াছড়ি। নির্ধারিত রুট পারমিটের রাস্তা ব্যবহার করার কথা থাকলেও মানছেনা চালক। কোন কোন সড়কে গতিসীমা ১৫-২০ থাকলেও গাড়ি চলছে ৩০-৪০ কি.মি. গতিতে। হরহামেসাই ওভারটেক করার চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখা যায় চালকদের। এছাড়া লক্কর-ঝক্কর লোকাল বাস, দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ মাঝাড়ি যানবাহনগুলোর চালকরাও বাধেন না সিটবেল্ট। সঠিক জায়গায় গাড়ি পার্ক করার কথা থাকলেও ব্যস্ত সড়কের পাশেই গাড়ি পার্কের ঘটনা নিত্তদিনের।
এদিকে যানজটের কারণে রাজধানীর ফুটপাতগুলোতেও আধিপত্য মটরসাইকেল চালকদের। জনসাধারণ চলাচল করলেও অনেক মটরসাইকেল চালকই দ্রুতগতিতে উচ্চস্বরে হর্ণ বাজিয়ে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করেন। পাশাপাশি রিকশাচালকরাও সুযোগ পেলে ফুটপাত ব্যবহার করেন।
এছাড়া ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও পথচারীদের অনেকেই তা ব্যবহার করছেন না। ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়েই দৌড়ে রাস্তা পারাপারের চিত্র অহরহ দেখা যায়। এমনকি শিশু সন্তান কোলে নিয়ে অথবা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে অনেকে রাস্তা পার হচ্ছেন।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর রাস্তাগুলোতে যানজটের ভয়ে প্রায়ই বিপরীত দিক দিয়ে (রং সাইড) প্রভাবশালী ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বহনকারী গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায়। এছাড়া সড়কগুলোতে গতিসীমা নিয়েও নেই কোন নির্দেশিকা। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে সংকেত বাতি থাকলেও তা রয়েছে অকার্যকর। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী চালকের পাশাপাশি গাড়ির কন্ডাক্টরেরও থাকতে হবে লাইসেন্স। এছাড়া উভয়েরই বয়স হতে হবে ১৮ বছর। তাবে রাজধানী ঘুড়ে অধিকাংশ গাড়িতেই দেখা যায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক ও কন্ডাক্টরকে। রাজধানীর প্রায় অর্ধশতাধিক গাড়ির কন্ডাক্টরের সাথে কথা বলে লাইসেন্স আছে কিনা জানতে চাইলে, সবাই অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছেন- 'কান্ডাক্টরির কোন লাইসেন্স দরকার হয়না'।
এদিকে ট্রাফিক আইন ঘেটে জানা যায়, বাংলাদেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে আনার জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘মোটরযান অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করে। আইনটিতে ১৭৭টি ধারা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে, ১৩৭ ধারা অনুসারে যে কোনো অপরাধের শাস্তি প্রদানে ২০০ টাকা জরিমানা হতে পারে। ১৩৯ ধারা অনুসারে নিষিদ্ধ হর্ন কিংবা শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র লাগালে ১০০ টাকা, ১৪০ ধারা অনুসারে আদেশ অমান্য, বাধা সৃষ্টি ও তথ্য প্রদানে অস্বীকার করলে ১ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা এবং বিপরীত দিকে গাড়ি চালালে ২০০ টাকা, ১৪২ ধারা অনুসারে নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালে ১ মাসের কারাদণ্ড বা ৩০০ টাকা, ১৪৩ ধারা অনুসারে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানাসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স সাসপেন্ড, ১৪৬ ধারা অনুসারে দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধে ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ১৪৯ ধারায় নিরাপত্তাহীন অবস্থায় গাড়ি ব্যবহার করলে ১ মাসের কারাদণ্ড বা ২৫০ টাকা, ১৫০ ধারা অনুসারে মারাত্বক ক্ষতিকর ধোঁয়া বের হলে ২০০ টাকা, ১৫১ ধারা অনুসারে আইনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন অবস্থায় গাড়ি বিক্রি বা গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন করলে ২ বছর কারাদণ্ড বা ৫০০০ টাকা, ১৫২ ধারা অনুসারে রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফিকেট অথবা পারমিট ছাড়া মোটরগাড়ি ব্যবহার করলে ৩ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা, ১৫৪ ধারা অনুসারে অনুমোদিত ওজন অতিক্রম করে গাড়ি চালালে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ১৫৫ ধারা অনুসারে বীমা ছাড়া বা মেয়াদ উত্তীর্ণের জন্য সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা, ১৫৬ ধারা অনুসারে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা, ১৫৭ ধারা অনুসারে প্রকাশ্য সড়কে অথবা প্রকাশ্য স্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক আইনগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাস, ট্রাক বা অন্য গণপরিবহন কিংবা পণ্যবাহী যানে কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই লাইসেন্স থাকতে হবে, আঠারো বছরের কম বয়সী কেউ কন্ডাক্টরের কাজ করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, আঠারো বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার্য স্থানে মোটরযান চালাতে পারবেন না, এক ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স অন্য ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারবেন না, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো মোটরযান চালানো যাবে না, মোটরসাইকেলে দু'জনের বেশি আরোহী হওয়া যাবে না, মোটরসাইকেল চালক এবং তার সঙ্গীকে অবশ্যই হেলমেট পরতে হবে, গাড়ির বাম্পার কিংবা ছাদে আরোহণ করা যাবে না, কোনো গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা যাবে না।
ট্রাফিক বিষয়ক এতসব আইন আর শাস্তি নির্ধারন করা থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। একদিকে মানছেন না চালকরা, অন্যদিকে এসব আইন বাস্তবায়নে তৎপরতার অভাব দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশদের। এসব ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বপালনকারী একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, আমরা আইন যথাযথ বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। মানুষ সংকেত বাতি অনুসরণ করেনা তাই তা বন্ধ রয়েছে। এছাড়া চোখের সামনে অনিয়ম দেখলেই গাড়ি থামিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিডি প্রতিদিন/৬ নভেম্বর ২০১৬/হিমেল-২০