মুক্তিযুদ্ধের 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স' (বিএলএফ) কমান্ডার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এসএম ইউসুফকে অন্তিম শয়ানে শায়িত করার সময়ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিভক্তে লিপ্ত হয়েছে! এর জের ধরে চট্টগ্রাম নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে অনুষ্ঠিত প্রধান জানাজা শেষে যথার্থ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সচেতন মানুষেরা।
তবে এ ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর কমান্ডের পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করা হয়েছে। ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
এর আগে অবশ্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ জননেতার প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান মেয়র ও জেলা প্রশাসকসহ সর্বস্তরের জনগণ। পরে পটিয়ায় দুই দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক মিয়াসহ দলের নগর, জেলা ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন জানান, 'শহরের জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া নিয়ে যা হয়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুই শাখার কমান্ডারদের স্নায়ুবিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে।
জমিয়তুল ফালাহে রণাঙ্গনের এ যোদ্ধার জানাজা শেষে প্রদত্ত ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার আগে মঞ্চ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়েও জেলা প্রশাসক বা তার প্রতিনিধি কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে খুঁজে পাওয়া যায়নি; বাজেনি বিউগলও; কফিনে দেওয়া হয়নি জাতীয় পতাকাও।
বিষয়টিতে তাৎক্ষণিকভাবেই অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন খোদ চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা।
এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, 'বিউগল না বাজিয়ে, জাতীয় পতাকা না দিয়ে, গার্ড অব অনার দেওয়াটি সম্মানজনক হয়নি। বিষয়টি সবাইকে ব্যথিত করেছে।'
অন্যদিকে, এ ঘটনার নেপথ্যে খোদ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আভ্যন্তরীণ বিভক্তির চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বিষয়টির জন্য অভিযোগের তীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমেদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মহানগর কমান্ডের সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তবুও এসএম ইউসুফের গ্রামের বাড়ি পটিয়ায় যথাযথ মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
অপরদিকে, মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ বলেন, এসএম ইউসুফের পরিবার ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের প্রত্যাশা অনুযায়ী জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে গার্ড অব অনারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে তাদের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতার বিষয়টি অস্বীকার করেননি তিনি।
পটিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাসেম ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেফায়েত উল্লাহসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উপস্থিতিতে এসএম ইউসুফকে জাতীয় পতাকার আচ্ছাদন দিয়ে ও বিউগল বাজিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন বলেন, একাধিক জানাজা হলে দাফনের আগে গার্ড অব অনার দেওয়ার যে নিয়ম সে অনুযায়ী পটিয়াতেই তা যথার্থভাবে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শাসকের রক্তচক্ষু এড়িয়ে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনে ‘শামীম ভাই’ ছদ্মনাম ধারণ করে দেশজুড়ে চষে বেড়িয়েছিলেন এসএম ইউসুফ। একাধারে মেধাবী ও জ্বালাময়ী বক্তা সাবেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি যুদ্ধপরবর্তী দেশে অসামান্য অবদান রাখা এ নেতার কণ্ঠে জীবন সায়হ্নে ছিল হতাশার সুর। তার শেষ সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেয়া। এতে নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘টোটালি ফ্রাসট্রেটেড।’
অভিমান নিয়ে যেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন অনেকটা প্রথাবিরোধী নেতা এসএম ইউসুফ। চোখ ও হৃদরোগ নিয়ে চাটগাঁর এই সন্তান ধানমন্ডিতেই থিতু হন।
মুঠোফোনে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণকালে তার কণ্ঠে ছিল অনেকটা চাপা ক্ষোভ আর হতাশার সুর। তার মতে, ‘আমি স্রোতে চলি না। আমি ব্যতিক্রম। উজানের মানুষ আমি।’
বিডি প্রতিদিন/ ১৮ নভেম্বর ২০১৬/ এনায়েত করিম-২০