৩০ অক্টোবর, ২০২০ ১১:২০

যেভাবে প্রতারণা করতেন নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর পরিচয়দানকারী সেই আসকারী

সাখাওয়াত কাওসার

যেভাবে প্রতারণা করতেন নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর পরিচয়দানকারী সেই আসকারী

নবাব পরিচয় দানকারী আলী হাসান আসকারী

নিজেকে পরিচয় দেন ঢাকার নবাব পরিবারের বংশধর। নাম নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন। আগে থেকেই ফটোগ্রাফারকে সেই নির্দেশনা দিয়ে রাখা হতো। এসব ছবি আপলোড করতেন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে। এগুলো ছিল প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার। 

তার গুণগান প্রচারের জন্য কাজ করত ১০-১২ সদস্যের একটি দল। এই দলের প্রধান হলেন মাওলানা সিরাজী। এরাই মাঝেমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া নবাবের ফোন রিসিভ করতেন। সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন। তারপর কৌশলে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন আসকারী। নিজের বিত্তবৈভব ও নবাবের বংশধর পরিচয় দিয়ে খাতির জমাতেন তিনি। তার বাবার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ৭০০ ওয়ার্ডবয়, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার নিয়োগ করা হবে জানিয়ে কর্মী দিতে বলতেন। 

নবাবের বংশধর হিসেবে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। তবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরপরই গা ঢাকা দিতেন তিনি। কেউ টাকা চাইতে গেলেই উল্টো হত্যার হুমকি দিতেন আসকারী। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নাম করেও প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার নাম ভাঙাতেন তিনি। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী স্বীকার করেছেন, তার এই প্রতারণার সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিল রাজু, সবুজ, সিরাজী, মুন্না। সম্প্রতি গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী একটি ফোরামে অর্থ ঢেলেছেন আসকারী। তাকে নেপথ্যে থেকে কেউ সহায়তা করছেন কিনা এ বিষয়টিও তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ভাবতে বাধ্য করছে।

ফেনীর বিখ্যাত রশিদিয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আবদুল আহাদ সালমানের সঙ্গেও গতকাল এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘চলতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে আসকারীর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়। ফেনীসহ আশপাশের এলাকায় আমার পরিবারের ঐতিহ্য রয়েছে। তাই আমাদের কথা বিশ্বাস করে ২০০ মানুষ আসকারীর কাছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন। আমরা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছি। এখন এলাকায় যেতে পারছি না। বুঝতেই পারছেন আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যদের কী অবস্থা!’

আবদুল আহাদ সালমান জানান, প্রথমে আড়াই লাখ টাকা করে লাগবে বললেও পরে মেডিকেল টেস্টের কথা বলে সাড়ে ৮ হাজার এবং দক্ষতা সার্টিফিকেট ম্যানেজ করার নাম করে জনপ্রতি ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা করে সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন আসকারী।

সালমানের ভাষ্য, পরিচয়ের পর তিনি যখন আসকারীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসেন, তখন তার সঙ্গে একবার ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে এবং পরে ধানমন্ডির জাহাজবাড়ির সামনে দেখা করেন। আসকারী এ সময় তাকে জাহাজবাড়িটি তার বাবার এবং তার বাবা সেটির সংস্কার কাজ করাচ্ছেন বলে সালমানকে জানান। সালমান বলেন, ‘নবাব পরিবারের বংশধর হিসেবে আমি তার সব কথাই বিশ্বাস করেছি।’

গ্রেফতারের খবরে সিটি কার্যালয়ে প্রতারিতরা: 
ভুয়া নবাব আসকারী গ্রেফতার হয়েছেন এমন খবরে একে একে ডজন খানেক লোক হাজির হয়েছিলেন সিটিটিসি কার্যালয়ে। পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়েছেন আসকারী। তাদেরই একজন ভুক্তভোগী নারায়ণগঞ্জের আল ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনাল হাফিজিয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মানজুর রহমান। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয় সিটিটিসি কার্যালয়ে বাইরে। কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলেন, সবুজ নামে পাবনার এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। পরে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার জন্য তার কাছেও কর্মী চাওয়া হয়। একই সঙ্গে পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কথা বলেন আসকারী। নবাবের বংশধর হিসেবে এবং আসকারীর মিথ্যা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিচয় বিশ্বাস করে তিনি গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ এলাকার ১০ জনের কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে আসকারীর হাতে তুলে দেন।

একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ইব্রাহীম আলী সাগর নামে সিঙ্গাপুর প্রবাসী এক যুবক। আসকারীর কথার ফাঁদে পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা সাগর এখন দেশে এসে উল্টো প্রতারণা মামলায় ফেরারি। গতকাল এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে পিন্টু নামে এক যুবকের মাধ্যমে আসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। আসকারী মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের গল্প বলে তাদের সেখানে চাকরি দেওয়ার কথা বলেন। তারা সাতজন সরল বিশ্বাসে আসকারীর হাতে ১৭ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন। টাকা দেওয়ার পর ফোন না ধরায় প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। পরে যোগাযোগ করলে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন সাগর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলী হাসান আসকারী নিজেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা পরিচয় দেন। বলেন, তাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পারিবারিক আত্মীয় হওয়ায় গণভবনে তার অবাধ যাতায়াত। ফেসবুক প্রোফাইলে মন্ত্রী-এমপিসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তার অসংখ্য ছবি। চলেন দেহরক্ষী নিয়ে। বলে বেড়ান, দুবাইয়ে রয়েছে স্বর্ণের কারখানা। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, থাকেন নিউইয়র্কে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানায় অংশীদার তার পরিবার। 

আসকারী একেক জায়গায় পরিচয় দেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী তার মামা। ফেসবুকে ‘নবাব আলী হাসান আসকারী (মুঘল প্রিন্স আওরঙ্গজেব)’ নামে রয়েছে তার ফেসবুক পেইজ। নিজ সম্পর্কে তিনি সেই পেইজে লিখেছেন, পাহাড়-পর্বত-আকাশ কেন লক্ষ্যসীমা হবে!! আকাশের ওপরেও নিশ্চয় কিছু আছে, আমার লক্ষ্য সেটাই। পেইজে তার অনুসারীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৩৫ জন। আসকারী তার ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘প্রতারণা যদি শিল্প হতো তাহলে আমি হতাম সেই শিল্পের নিপুণ কারিগর।’ বছর পাঁচেক আগে নিজের নামের সঙ্গে খাজা শব্দটি যোগ করেন আলী হাসান আসকারী। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন তিনি।


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর