বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষেরও নিজেদের উন্নয়ন করার একটি আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণা আছে। তবে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এই সমন্বয় ঘটাতে পারলে উন্নয়ন প্রেরণা গতি পায়। লুটপাট, মাস্তানির মতো বিষয় উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল রবিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘আকাঙ্ক্ষার গতি প্রেরণা : বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্প’ শীর্ষক সেমিনারে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও বিআইডিএসের গবেষক মাহির এ রহমান সেমিনারে যৌথভাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আলোচনা করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এই নিজস্ব সংস্কৃতি উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাকে প্রেরণা দেয়। বাংলাদেশের এমন কিছু নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষায় প্রেরণা দিয়েছে। যেমন : নারীর কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো—এসবই সমন্বিতভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি নির্ণয় করতে হলে শুধু অর্থনীতির মূলধারার হিসাব দিয়ে মূল্যায়ন করলে হবে না। একটি দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কৃষি উৎপাদনসহ সব কিছু মূল্যায়ন করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। সেটিই উঠে এসেছে আজকের গবেষণায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ধর্ম বা জাতপাতের বিভেদ নেই বলেই এত অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে’।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে পার্থক্য আছে; কিন্তু সেটা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ফলে তারা সবাই উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রেরণা পেয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রথম হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, যখন তারা প্রথম জমিতে গিয়ে কাজ শুরু করেছে। এর পরবর্তী সময়ে এরশাদের আমলে প্রথম নিম্নবিত্ত নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে শুরু করতে পেরেছিল’।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের আশা বা আকাঙ্ক্ষা মানুষের জীবন পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি তাদের এই পরিবর্তনে সরকারি বিনিয়োগও বড় ভূমিকা রেখেছে। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, সেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিয়েছে। এখানে যদি সরকার বিনিয়োগ না করত, তাহলে ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতো না। যদিও আমরা কর্মসংস্থানে ভালো করতে পারিনি’।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্লেষণের ফলাফল আমাদের অনুমিত ধারণাগুলোকে সমর্থন করে। আমরা দেখেছি, শিশুমৃত্যুর হার কমার সঙ্গে সঙ্গে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়, যদিও এই ফলাফলটি পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্ববহ নয়। কিন্তু নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষার হার এবং দেশে বিদ্যুতায়নের হার মাথাপিছু আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই ফলাফল পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রাথমিকভাবে সময়ের সঙ্গে সূচকগুলোর গতিধারায় কিছু আশাব্যঞ্জক আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ করেছি’।
এ সময় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, ‘বাংলাদেশকে উন্নয়নের প্যারাডক্স বলা হয়। আমি মনে করি, সেটি এসেছে এই আকাঙ্ক্ষা থেকে। দেশের সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে আকাঙ্ক্ষার কারণেই। দেশের কৃষক, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, এমনকি পরিবারগুলোর আকাঙ্ক্ষাও মাথাপিছু আয় বাড়াতে কাজ করেছে’।