বিগত সরকারের সময়ে গুমের ঘটনায় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সেনা সদর দপ্তর। মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম গতকাল সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ডেপুটেশনে থাকেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। ডেপুটেশনে থাকা কিছু সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর তদন্ত চলমান। এ তদন্তে যদি গুমের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা থাকবে। ভুক্তভোগী কোনো পরিবার সহযোগিতা চাইলে তাদেরও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই সেনা কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল শফিকুল ইসলাম দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র লুট হয়, যার ৮০ শতাংশ এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় প্রায় ১২ হাজার অস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৯ হাজারের বেশি অস্ত্র শুধু সেনাবাহিনী উদ্ধার করেছে। আগামী নির্বাচনের আগে যতদূর সম্ভব বাকি অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী তৎপর রয়েছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গও সংবাদ সম্মেলনে আসে। সেনাবাহিনী কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে-জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। পাওয়ামাত্র অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহায়তা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।’ কথিত জনতার মাধ্যমে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে হেনস্তা করার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে সংবাদ সম্মেলনে। জবাবে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনার পর দিনই আমরা একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে হস্তান্তর করি। এরপর যদি কেউ জামিন পেয়ে যান, তাহলে সেনাবাহিনীর কিছু করার থাকে না।’ এ ধরনের ঘটনায় সেনাবাহিনী ‘সব সময় সোচ্চার’ বলে মন্তব্য করেন এই সেনা কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার ভোরে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে সেনা অভিযানে পাহাড়ি সংগঠন কেএনএফের দুজন নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে ‘বড় সাফল্য’ হিসেবে দেখছে সেনাবাহিনী। এ ঘটনা পাহাড়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেএনএফের ভয়ে যেসব বম পরিবার চলে গিয়েছিল, তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত ১৩৮ জন তাদের বসতভিটায় ফিরে এসেছে।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে কর্নেল শফিকুল ইসলাম জানান, চার শর বেশি কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর পক্ষে অলিগলিতে থাকা সম্ভব নয়। তবে তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী দ্রুত গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ ছাড়া গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী ২৬টি অবৈধ অস্ত্র ও ১০০ রাউন্ড গুলির খোঁজ পেয়েছে। আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে মোট ৯ হাজার ৬৯২টি অস্ত্র। একই সময়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৫৬২ জনসহ মোট ১৫ হাজার ৬৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলেও জানান এই সেনা কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২৬ জুন কুমিল্লার মুরাদনগরের একটি গ্রামে সংঘটিত নারী নির্যাতন ও বর্বরতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। মূল আসামি ফজর আলী ও আরও চারজন ভিডিও ধারণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ভুক্তভোগী পরিবারের সুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার কার্যক্রমে পূর্ণ সহযোগিতা করছে। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানে সেনাবাহিনী ৪ হাজার ৭৯০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এর মধ্যে সিএমএইচ ঢাকায় ২২ জন চিকিৎসাধীন।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৭ জুন ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রথযাত্রা উৎসবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাবাহিনী দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে গত দুই সপ্তাহে ৪৫ জন মাদক কারবারি এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫ হাজার ৫২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সেনা সদর দপ্তর জানায়, বিরাজমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভবিষ্যতে জানমালের ক্ষতিসাধন, মব ভায়োলেন্স এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেবে।