নগদ লেনদেন বা টাকা ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ দ্রুত ক্যাশলেস বা নগদ টাকাবিহীন অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হলেও এ যাত্রা এখনো চ্যালেঞ্জপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার ঘটলে শুধু খরচ কমবে না, বরং অর্থনীতির স্বচ্ছতা ও প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। তবে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ক্যাশ আউট খরচ কমাতে হবে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটানের তুলনায় আমাদের ক্যাশ আউট খরচ অনেক বেশি।
নগদবিহীন অর্থনীতি গড়ে তোলা : ফিনটেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম মাশরুর রিয়াজ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (প্রায় ৩ কোটি) এখনো ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে। অথচ বিকাশের ২ কোটি ১২ লাখ ও নগদের ৪৫ লাখ ব্যবহারকারী দেখাচ্ছে, প্রযুক্তি কীভাবে গ্রামীণ জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছে। বর্তমানে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে মোবাইল মানি বিশেষভাবে নারীদের ও নিম্ন আয়ের পরিবারকে ক্ষমতায়িত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, নগদের ওপর নির্ভরতার কারণে প্রতি বছর ২ হাজার ৮ কোটি টাকা অপচয় হয়। দুর্বল ক্যাশলেস অবকাঠামো, কম ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং ডিজিটাল লেনদেনে ধীর গ্রহণযোগ্যতা এ ক্ষতির মূল কারণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবসা ও নাগরিকদের জন্য খরচ এবং ঝুঁকি দুটোই কমাতে পারে। নগদ লেনদেন কর ফাঁকি ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে। বিপরীতে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড থাকায় সরকারি ভর্তুকি, পেনশন ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় এবং লিকেজ কমে আসে।
বাংলাদেশের ফিনটেক ইকোসিস্টেমে বর্তমানে ৩৩২টি কোম্পানি কাজ করছে, যার মধ্যে ২৬টি ইতোমধ্যে বিনিয়োগ পেয়েছে। এ খাতে এ পর্যন্ত ২৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে, যা বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান আস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডিজিটাল আর্থিক খাতকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের ইতোমধ্যে শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে ১৮ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার মোবাইল ফোন গ্রাহক, ১৩ কোটি ৬ হাজার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ১১ কোটি ৫৫ লাখ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। সরকার ২০২৭ সালের মধ্যে খুচরা লেনদেনের ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল করার লক্ষ্য নিয়েছে। আর ২০৩১ সালের মধ্যে পুরোপুরি নগদবিহীন অর্থনীতি গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, কেবল ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসার ঘটলেই বাংলাদেশের জিডিপি বছরে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ৬২০ কোটি ডলার (৫০ হাজার ৫৮ কোটি টাকা)। ইতোমধ্যে ই-কমার্স খাত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাজারের আকার দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ২২৮ কোটি ডলার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নগদনির্ভরতার কারণ নারী, প্রবীণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার কম। গ্রামীণ এলাকায় দুর্বল ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ। নগদ লেনদেনের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত ঝোঁক এবং সাইবার জালিয়াতির ভয়।
এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, নগদনির্ভরতা কমাতে হলে সমন্বিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি, দ্রুতগতির ইন্টারনেট ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত, জনগণের মধ্যে ডিজিটাল ও আর্থিক সাক্ষরতা বাড়ানো, এমএফএস ক্যাশ আউট খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং ফিনটেক কোম্পানি ও ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম