লুইজিয়ানাভিত্তিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান আর্জেন্ট এলএনজি চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে জানায়, প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২ কোটি ৫০ লাখ টন সক্ষমতার একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করছে। তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি অ-বাধ্যতামূলক চুক্তি (নন-বাইন্ডিং এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করেছে, যার আওতায় বাংলাদেশ প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে পারবে। যদিও আর্জেন্ট এলএনজি একটি গ্রীনফিল্ড প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে ২০৩০ সালের আগে কোনো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। গ্যাস বিষয়ক ওই চুক্তিতে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে ওই সময়েই প্রশ্ন উঠেছিল।
জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর ফেব্রুয়ারিতে জাপান সফর করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। টোকিও ও ওসাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও বিডার যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ইনভেস্ট বাংলাদেশ রোড শো ২০২৫। এপ্রিলে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি দলে যোগ দিয়ে কাতারের দোহায় যান বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান। সেখানে তিনি বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও শিল্প উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন।
জুলাইয়ে চৌধুরী আশিক চীনের সাংহাইয়ে বিডার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেন। সেখানে বাংলাদেশ–চায়না ইনভেস্টমেন্ট সেমিনার ২০২৫–এ প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকে চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল ও আইটি খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানান।
আগস্টে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ–মালয়েশিয়া ব্যবসায়িক ফোরামে অংশ নেন আশিক মাহমুদ বিন হারুন। সেখানে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বিশেষ প্রণোদনার সুযোগ ব্যাখ্যা করেন তিনি।
সর্বশেষ ৬ অক্টোবর বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (মিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষের (পিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ছয় দিনের সফরে তুরস্কে পৌঁছায়। সফরে আয়োজিত সেমিনারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি একাধিক জি–টু–বি পর্যায়ের সভায় অংশ নেন আশিক চৌধুরী।
নিয়োগ পাওয়ার পর গত এক বছরের বেশি সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সফরে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। তার চমকপ্রদ উপস্থাপনা ও আলোচনায় প্রায় প্রতিটি সফরেই একেকটি খাতের নতুন আঙ্গিক ও আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বিডা, বেজা, মিডা ও পিপিপিএ–সংশ্লিষ্টরা। এতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।
তবে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে কতটা এফডিআই আকৃষ্ট হবে, তা সময়সাপেক্ষ বলেই মত প্রকাশ করছেন বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্টরা, যার প্রতিফলন রয়েছে সরকারি পরিসংখ্যানে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা সেলের (এফআইইডি) প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল–জুন) নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩০ কোটি ৩২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি–মার্চ) নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৭৮ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবে বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৬১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন (ইকুইটি), পুনর্বিনিয়োগ (রিইনভেস্টেড আর্নিংস) ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রাকোম্পানি লোন) সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে এফডিআই প্রবাহের হিসাব প্রকাশ করে। এ তিন উপখাতের সব ক’টিতেই এফডিআই প্রবাহ কমেছে।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের সঙ্গে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের এফডিআই প্রবাহের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিট এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বিদ্যমান বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের পুনর্বিনিয়োগ, যা এই এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে বেড়েছে ৫৯৫ শতাংশের বেশি। একই সময়ে মূলধন বা ইকুইটি কমেছে ৬২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ইকুইটি বা নতুন মূলধন কিংবা পুঁজি বিনিয়োগ কমেছে।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এফডিআই প্রবাহ প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ৬১ দশমিক ৫৩ শতাংশ হ্রাস প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বিডার মুখপাত্র ও হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান রোচি বলেন, “২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য পরিবেশে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্য উত্তেজনা, রেড সি ও পানামা খালে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন এবং বিভিন্ন দেশে রপ্তানিমুখী ভর্তুকি ও শুল্কনীতির পরিবর্তন—এসব কারণে বৈশ্বিকভাবে সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি নতুন দেশীয় বা বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা স্থগিত বা পুনর্মূল্যায়ন করেছে। ফলে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোয়, বিশেষ করে গ্রীনফিল্ড ইকুইটি বিনিয়োগে একটি সাময়িক মন্দা দেখা গেছে।”
সিজনাল বা মৌসুমি প্রভাবের বিষয়টি উল্লেখ করে নাহিয়ান রহমান আরও বলেন, “অনেক সময় বছরের প্রথম প্রান্তিকে নির্দিষ্ট প্রকল্পে এককালীন বড় অঙ্কের ইকুইটি বা ঋণ আসতে পারে, যা পরবর্তী প্রান্তিকে তুলনামূলকভাবে কম দেখায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রান্তিকে কমে যাওয়াটা একটি স্বাভাবিক ‘সিজনালিটি ইমপ্যাক্ট’। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের এপ্রিল–জুনেও এ সিজনালিটির প্রভাবে মোট বিনিয়োগ কমেছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ।”
উপরন্তু এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিনিয়োগ প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধির কারণে দ্বিতীয় প্রান্তিকের হ্রাসের হার তুলনামূলক নয় বলেও দাবি করেন তিনি।
২০২৪–এর এপ্রিল–জুনের তুলনায় ২০২৫–এর একই প্রান্তিকে মোট বিনিয়োগ ১১ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়াকে একটি ভালো খবর জানিয়ে নাহিয়ান রহমান বলেন, “এ বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হলো রিইনভেস্টেড আর্নিংস, অর্থাৎ যারা এরই মধ্যে বাংলাদেশে কাজ করছে, তারা তাদের আয় পুনরায় বাংলাদেশেই বিনিয়োগ করেছে। বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী এবং তারা মুনাফা তুলতে না গিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করছেন, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন। ইকুইটি এফডিআই ৬২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক এ চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে বিডা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৩২টি সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। যেমন নিয়ন্ত্রক জটিলতা ও নথিপত্রের দীর্ঘসূত্রতা, মুদ্রা বিনিময় ও লভ্যাংশ প্রেরণ–সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ইত্যাদি।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং বিদ্যুৎ–জ্বালানি খাতে সমস্যার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের এফডিআই প্রবাহে। গত বছরের এপ্রিল–জুন প্রান্তিকের তুলনায় এ বছরের একই প্রান্তিকে রিইনভেস্টেড আর্নিংস বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক পর্যন্তও দেশে ডলারের সংকট বেশ তীব্র ছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। তার পরও চলতি বছর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মুনাফার একটি অংশ প্রত্যাবাসন না করে সেটি চলতি মূলধনসহ ব্যবসার প্রয়োজনে ব্যয় করে থাকতে পারে। তাছাড়া ব্যবসার খরচ বাড়ার কারণেও কোম্পানিগুলোর ব্যয় বেড়েছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে চলতি মূলধনের অর্থ না নিয়ে মুনাফার অর্থ কাজে লাগিয়ে থাকতে পারে। এসব কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর এফডিআই–এর পরিসংখ্যানে রিইনভেস্টেড আর্নিংসের পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে।
জাপান–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সভাপতি তারেক রফি ভূঁইয়া (জুন) গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা মনে করি বাংলাদেশের প্রতি জাপান ও অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এখনো আছে। তারা কিছুটা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মনোভাবের মধ্যে রয়েছে। একটা স্থিতিশীল সরকার এলে তারা আরও বিনিয়োগ করবে। এ মুহূর্তে যারা বিনিয়োগ করছে, যেমন চীনা কোম্পানি, তারা ট্যারিফ ইত্যাদির কারণে হয়তো এখনই বিনিয়োগ করছে। কিন্তু যারা অপেক্ষা করতে পারছে, তারা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করবে। যার প্রতিফলন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। সম্প্রতি প্রতিনিধি দল নিয়ে জাপানে ঘুরে এসেছি। টোকিও, ওসাকা—দুই জায়গায়ই ১০০ জনেরও বেশি বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণে বড় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সময় বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আগ্রহ দেখতে পেয়েছি। আসলে বিনিয়োগকারী যে দেশেরই হোক, তারা নীতির স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। বর্তমান সরকার যেহেতু অন্তর্বর্তী, তাই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য তারা স্থিতিশীলতাটাই চায়।”
বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তারা দেখছেন বাংলাদেশে তাদের লগ্নি করা অর্থ নিরাপদ ও সুরক্ষিত কিনা। যা লগ্নি হয়েছে, সেই লগ্নি ফিরে আসবে কিনা। ২০২৪ সালের আগেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের আগ্রহ বাস্তবায়নে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল কিছু প্রতিষ্ঠানকে। একটা পর্যায়ে গত সরকারকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আভাসও দেওয়া হয়েছিল। কর, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যবসার পরিবেশের সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো এখনো কাটেনি বা ক্ষেত্রবিশেষে রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে তারা। মোটা দাগে প্রতিবন্ধকতাগুলো এখনো উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ–মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিএমসিসিআই) সভাপতি সাব্বির এ খান গণমাধ্যমকে বলেন, “বাংলাদেশে অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ মালয়েশিয়া। রবি ও ইডটকো—এরাই বড় বিনিয়োগকারী। এ দুই প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সাল থেকে বিনিয়োগের জন্য তহবিল প্রস্তুত করে রেখেছে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে তারা অপেক্ষা করছে বিনিয়োগ পরিবেশ পর্যবেক্ষণে। যখন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন, তখন দেশটির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগের মুভমেন্ট এখনো দেখা যাচ্ছে না। আমি মনে করছি, তারা অপেক্ষায় আছে—এটাই মূল কারণ। তারা অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশের অপেক্ষায় আছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফডিআই বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে আমূল সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে (এসইজেড) দ্রুত কার্যকর ও পূর্ণরূপে চালু করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা নির্ধারিত সুবিধা ও অবকাঠামো পায়। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য নীতির উদারীকরণ প্রয়োজন, বিশেষ করে আমদানি–রপ্তানির প্রক্রিয়ায় শুল্ক, বাধা এবং অনুমোদন নীতি সরলীকরণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ডিরেগুলেশন বা অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি কর কাঠামোয় স্বচ্ছতা, চুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুততা এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমশক্তি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সুযোগ বাড়িয়ে বাংলাদেশকে একটি বিনিয়োগবান্ধব গন্তব্যে পরিণত করতে পারলেই এফডিআই প্রবাহ আবারও গতিশীল করা সম্ভব হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)–এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, “চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল–জুন) এফডিআই প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ৬১ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমেছে। এটি একটি গুরুতর সংকেত, যা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ও সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের পতন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের পথকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি স্পষ্ট করছে যে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করতে অনিচ্ছুক বা অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। যদিও আগের অর্থবছরের এপ্রিল–জুন সময়ের তুলনায় সামগ্রিকভাবে এফডিআই ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস পুনর্বিনিয়োগ।”
নতুন ইকুইটি বিনিয়োগ কমে গেছে ৬২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, যা উদ্বেগজনক—উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, “এটি ইঙ্গিত করে যে পূর্ববর্তী বিনিয়োগকারীরা আংশিক আস্থা রাখলেও নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু নীতিগত নয়, কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি। বাংলাদেশে এখনো অনেক প্রক্রিয়া জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং অদক্ষ, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।”
শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই নন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দেশের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বল অবস্থা, চাঁদাবাজি, প্রশাসনিক জটিলতাসহ নানাবিধ কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগের ঝুঁকি নিচ্ছেন না স্থানীয় উদ্যোক্তারাও। তারা বলছেন, সবকিছুর টেকসই সমাধান হবে এমন উচ্চাশা না থাকলেও বিনিয়োগের জন্য তারা নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে আছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন হতে এখনো প্রায় চার মাস বাকি। এ সময়ের মধ্যে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটার কোনো আশা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখভাল করা সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। সংগঠনটির সভাপতি জাভেদ আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে এফডিআই হ্রাসের খবর আমাদের সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে। এটি আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সংকেত। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারি নীতিগুলোর আরও স্বচ্ছতা, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ প্রবণতা পাল্টানো সম্ভব। এফআইসিসিআই বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করে এ লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে প্রস্তুত, যাতে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে ওঠে।”
সূত্র: বণিক বার্তা
বিডি প্রতিদিন/আশিক