তিন দফা দাবিতে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমাতে গতকাল সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। এ সময় জলকামান নিক্ষেপের পাশাপাশি তাদের ওপর লাঠিচার্জও করা হয়। তখন পুলিশের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ ও শিক্ষার্থী উভয়ই পক্ষের অনেকে আহত হন। এদিকে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করে সুপারিশ দিতে চার উপদেষ্টা, প্রকৌশল ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ কমিটিকে ডিপ্লোমাধারীদের দাবির বিষয়েও সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। গতকাল রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তবে আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা সরকারের গঠন করে দেওয়া কমিটি প্রত্যাখ্যান করে পাঁচ দফার ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে সাত দফা দাবিতে গতকাল প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ। এ ছাড়া গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক আবু বোরহান মো. বদরুজ্জামান সরকারের প্রতি আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নামের আগে প্রকৌশলী লিখতে না দেওয়া, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কাউকে পদোন্নতি দিয়ে নবম গ্রেডে উন্নীত না করা ও দশম গ্রেডের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্নাতক প্রকৌশলীদের সুযোগ দেওয়া। গতকাল বেলা ১১টার দিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শাহবাগে অবস্থান নেন আন্দোলনরত প্রকৌশলে অধ্যয়নরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে শাহবাগ ও আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রেস ক্লাব, পল্টন, মৎস্য ভবন, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, সায়েন্সল্যাবসহ রাজধানীজুড়ে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। বেলা দেড়টার দিকে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে বাধা দেয়। এ সময় আন্দোলনরতরা ব্যারিকেড অতিক্রম করার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তাদের ওপর জলকামানও ব্যবহার করা হয়।
আহত ১৫ শিক্ষার্থী : এ সময় বুয়েট শিক্ষার্থী নাবিদ (২১), শাহাদাত (২২), নাভিদ (২১), রুয়েট শিক্ষার্থী রিজন (২৩) ও আহছানউল্লা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিবসহ (২২) অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহত শিক্ষার্থী রিজন জানান, তিন দফা দাবি নিয়ে শাহবাগ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনার দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ দাবির সমর্থনে শুধু বুয়েট নয়, বাংলাদেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমর্থন রয়েছে।
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ। আন্দোলনরতদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যাপারে আলোচনা চলছিল। সচিবালয়ে উপদেষ্টারাও এটা নিয়ে কাজ করছিলেন। তাই শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল, শাহবাগে অবস্থান করতে। কিন্তু আলোচনা চলাকালীন হঠাৎ শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে রওনা হন। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এ ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
আহত আট পুলিশ সদস্য : গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এ ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর আট সদস্য আহত হয়েছেন। আহতদের রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। আহতরা হলেন ডিএমপির রমনা জোনের ডিসি মাসুদ আলম, অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) রেজোয়ানুল ইসলাম (৩৭), এসআই তৌহিদুল ইসলাম, এএসআই ফরহাদ আলী (২৯), কনস্টেবল আদিব (২২), কনস্টেবল আমিনুল ইসলাম (২০) ও কনস্টেবল শ্রাবণ (২০)। তাদের মধ্যে তৌহিদুল ইসলাম ও আদিবের অবস্থা গুরুতর।
দাবির যৌক্তিকতা যাচাইয়ে কমিটি : প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করে সুপারিশ দিতে কমিটি গঠন করেছে সরকার। গতকাল রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এ-সংক্রন্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবিসমূহের যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সড়ক, রেল ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে। সদস্য হিসেবে রয়েছেন গৃহায়ন-গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সভাপতি প্রকৌশলী মো. কবির হোসেন, বোর্ড অব অ্যাক্রেডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. প্রকৌশলী তানভির মঞ্জুর। কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হককে। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটি প্রত্যাখ্যান করে পাঁচ দফা দাবি : প্রকৌশল শিক্ষার্থী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দাবির যৌক্তিকতা নিরীক্ষায় সরকারের গঠন করে দেওয়া কমিটি প্রত্যাখ্যান করে পাঁচ দফার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে সংবাদ সম্মেলনে দাবিগুলো তুলে ধরেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ। এর মধ্যে রয়েছে- প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে ক্ষমা চাওয়া, পুলিশের হামলায় আহত সব শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে, আন্দোলন চলাকালীন সব শিক্ষার্থীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যে পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের হামলার সঙ্গে জড়িত- তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
দাবি আদায়ে স্মারকলিপি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের : এর আগে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্রের’ পরিপ্রেক্ষিতে সাত দফা দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- প্রকৌশল কর্মক্ষেত্র ডেস্ক ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভাগ করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ; দশম গ্রেডভুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সংরক্ষণ; মেধার অপচয় রোধে প্রকৌশলীদের কারিগরি ক্যাডার ব্যতীত অন্য ক্যাডারে নিয়োগ বন্ধসহ প্রকৌশল পেশা পরিবর্তন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
বুয়েট শিক্ষার্থীর জন্য চুয়েট শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকনকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদ এবং প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের তিন দফা দাবিতে সারা দেশে উত্তাল আন্দোলন চলছে। এরই অংশ হিসেবে এবং সংঘর্ষের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামেন। গতকাল বিকালে নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও ‘ব্লকেড কর্মসূচি’ পালন করেছেন তাঁরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া, কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘২৪-এর বাংলায়, ডিপ্লোমা কোটার ঠাঁই নাই’, ‘জেগেছেরে জেগেছে, প্রকৌশল সমাজ জেগেছে’ শীর্ষক নানান স্লোগান দেন।
প্রসঙ্গত, ২৫ আগস্ট বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান রোকন নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম হোসেনের কক্ষে ডাক পান। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ২০-২৫ জন প্রকৌশল ডিপ্লোমাধারী কর্মচারী-কর্মকর্তা। তাঁরা রোকনকে ঘিরে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন এবং হত্যার হুমকি দেন।