‘সংবিধানের ওপরে জুলাই সনদের স্থান’- ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্কে জড়াচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। পরস্পরের মধ্যে বিভেদ তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব। সংবিধানের ওপরে জুলাই সনদের স্থান দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি সরাসরি বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। বিষয়টি নিয়ে তাদের কোনো ধরনের আপত্তি নেই বলে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তাদের সঙ্গে ১৬৬টি ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করলেও জুলাই সনদের স্থান যে সংবিধানের ওপরে হবে- এ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। কমিশনের পক্ষ থেকে যখন জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয় তখনই বিষয়টি নজর কাড়ে। আলোচনার জন্ম দেয়। কয়েকটি দল তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এমনকি কোনো কোনো দল সংবিধানের ওপরে জুলাই সনদকে স্থান দেওয়ায় এতে স্বাক্ষর না করার ঘোষণাও দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করে কমিশন। এ পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিভেদের বরফ গলেনি বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আপাতত দলগুলোর সঙ্গে নানা সময় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছি। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সংলাপ চলছে। এর বাইরে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আমরা চাই- সর্বসম্মতিক্রমে একটা জুলাই সনদ তৈরি করতে। আমাদের এ চেষ্টা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, ‘এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।’ এটাকে অনেকে ব্যাখ্যা করছেন জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতা দলিল। কোনো সমঝোতা দলিলকে ‘সংবিধানের ঊর্ধ্বে’ অবস্থান দেওয়া যায় না। সেটা করা হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। অঙ্গীকারনামায় যা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে দৃশ্যতই সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার মতো কিছু বিষয় আছে, যেটা আমার মনে হয় সমীচীন নয়। এখন আমাদের এই চিন্তা করলে হবে না যে, আমাদের দেশে সংবিধান নেই। জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে রাখা হলে তা খারাপ নজির হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, এটি নিশ্চিত করতে হবে যেন ভবিষ্যতে অন্য কোনো সনদ দিয়ে জুলাই সনদ প্রতিস্থাপন করা না যায়। একই ইস্যু নিয়ে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই বলে জানানো হয়েছে। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, সংবিধানের ৭(১) এবং ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ই চূড়ান্ত আইন। সংবিধানেই জনগণের অভিপ্রায়কে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দিয়েছে। জুলাই সনদ জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তির দলিল। তাই সংবিধানের ওপর সনদের প্রাধান্য থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ইস্যু নিয়ে কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ তারা খসড়ায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দিয়ে বসে আছে। এটা ঠিক হয়নি বলে তিনি জানান। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। এই রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল কখনোই সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পেতে পারে না। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় আপত্তির একটি জায়গা। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার কারণে আটকে আছে জুলাই জাতীয় সনদ। এ দুটি বিষয় নিয়ে আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার পরিকল্পনা আছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। এটি হবে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের তৃতীয় পর্বের আলোচনা। এর মধ্য দিয়ে সনদ চূড়ান্ত রূপ পেতে পারে। তবে এটি চূড়ান্ত হতে আরও সময় লাগবে।