লকডাউনের দীর্ঘ যাতনা শেষে কিছুটা অবসাদের আশায় যারা গ্রীষ্মের আম, জাম, কাঁঠালের আমেজে স্বজনের সাথে কটা দিন অতিবাহিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশেরই হতাশ হতে হচ্ছে। কারণ, করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও এখন আক্রান্ত। সেজন্যে কঠোর লকডাউনে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অনেক প্রবাসী শেষ মুহূর্তে এয়ালাইন্সকে অনুরোধ করে টিকেট বাতিল কিংবা ভ্রমণ স্থগিত রাখলেও কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সপরিবারে রওয়ানা দিয়েছেন নিউইয়র্ক থেকে।
রবিবার ভোর রাতে ঢাকায় অবতরণ করবে (অর্থাৎ লকডাউনের একদিন আগে) আমিরাত এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট, সেটি জেএফকে থেকে রওয়ানা দেয় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায়। এই ফ্লাইটে একটি আসনও খালি ছিল না এবং যাত্রীগণের ৯০% ছিলেন বাংলাদেশি-আমেরিকান এবং তাদের আমেরিকান সন্তানেরা। এসব যাত্রীর অধিকাংশকেই এক ধরনের বিষন্নতায় আক্রান্ত থাকতে দেখা গেলেও শিশু-কিশোরেরা ছিল প্রফুল্ল। তারা বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারনা না পেয়ে অথবা অনুধাবন করার চেষ্টা না করে মা-বাবার স্বজনের সাথে মিলিত হবার অদম্য এক বাসনাকেও প্রাধান্য দিচ্ছে। মা-বাবা অথবা অনলাইনের তথ্য জেনে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের মানুষের অতিথিপরায়ন এবং গ্রামের খোলা ময়দানে সীমাহীন আনন্দে সমবয়সীদের সাথে মেতে থাকার প্রত্যাশাকেও অনাবিল এক আনন্দের সাথে দেখছে।
ঢাকাগামী একাধিক প্রবাসীর সাথে আলাপকালে তারা জানালেন, বাংলাদেশেও লকডাউনের কথা জেনেছি। তারপরও যাচ্ছি। আম-কাঁঠালের মৌসুম শেষ হচ্ছে। স্বজনেরা অনুরোধ জানাচ্ছেন একত্রে মৌসুমি ফলের আনন্দ ছাড়াও সামনের কুরবানির ঈদ করতে। আমেরিকায় পূর্ণ ডোজের টিকা নেয়ায় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। সেটিও স্বদেশে অবকাশযাপনে উৎসাহিত করছে। কেউ কেউ বললেন, বাংলাদেশ লকডাউনে থাকলেও আমেরিকার মতো নিশ্চয়ই হবে না। বড় কথা হচ্ছে, আত্মীয়-স্বজনের অধিকাংশই বাড়িতে থাকবেন। চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই।
ঢাকাগামী এসব যাত্রীর অধিকাংশই যাবেন রাজধানীর বাইরে জেলা এবং উপজেলা শহরে। লকডাউনের তাণ্ডবে কীভাবে তারা এয়ারপোর্ট থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবেন জানতে চাইলে কয়েকজন বললেন, স্বজনেরা সে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কঠোর লকডাউনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী নিশ্চয়ই পথে থামাবে না। সে সুযোগেও গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন বলে প্রত্যাশা তাদের।
১২ বছর পর স্বামী-সন্তান নিয়ে রওনা দেয়া এক যাত্রী বললেন, আমি অসুস্থ। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ওষুধসহ রওয়ানা দিলাম। জীবনের ঝুঁকি রয়েছে জানি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের সাথে আম-জাম-কাঁঠালের আমেজে মিলিত হবার যে পরম তৃপ্তি সেটি দূর করবে সব ঝুঁকি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই যাত্রী বললেন, গত ১৪ মাসে এই নিউইয়র্কে কত পরিচিতজনকে হারিয়েছি। করোনার ভয়ঙ্কর থাকায় ছটফট করা অনেক প্রবাসীর অবস্থা খুব কাছে থেকে অবলোকন করেছি। নিজেও আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলাম কয়েকদিন। বাংলাদেশে তেমন পরিস্থিতি এখনও হয়নি। এছাড়া সকলেই যদি লকডাউনের মর্ম আন্তরিক অর্থে বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, তাহলে কোন সমস্যা কারোরই হওয়ার কথা নয়। আমি সকলের দোয়া চাচ্ছি যাতে সহি-সালামতে ঈদের পর নিউইয়র্কে ফিরতে পারি।
বিশ্ববাংলা টোয়েন্টিফোর টিভির সিইও এবং যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কোষাধ্যক্ষ আলিম খান আকাশ সপরিবারে রওয়ানা দিয়েছেন ঐ ফ্লাইটে। জেএফকে এয়ারপোর্টে তিনি এ সংবাদদাতাকে বললেন, ইতিপূর্বে আরও দু’বার টিকিট কেটে তা বাতিল করেছি। এবার বাতিলের করিনি। স্বজনবেষ্টিত হয়ে নিজ গাছের আম, জাম, কাঁঠাল এনে খাবো- এদেশে জন্মগ্রহণকারি সন্তানদের বাঙালির ঐতিহ্যবাহি সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করার এমন সুযোগ বছরে একবারই আসে। সেটি হারাতে চাইনি। করোনার ভীতি আছে জানি, তবুও যাচ্ছি।
নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, মিশিগান, লসএঞ্জেলেসসহ বিভিন্ন স্থানের ট্র্যাভেল ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার পরিপ্রেক্ষিতে সিংহভাগ প্রবাসী বাংলাদেশে যাবার পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন। এর ফলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা