শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রংপুরের বালিকাবধূদের ঘুরে দাঁড়ানো

১০ বছরে ৩৪৭ কিশোরী আলোর ভুবনে

রেজাউল করিম মানিক, রংপুর

রংপুরের বালিকাবধূদের ঘুরে দাঁড়ানো

রংপুর বিভাগের বিভিন্ন গ্রামে এখনো বাল্যবিয়ের কারণে বালিকাবধূদের ঘর ভেঙেছে বিয়ের বয়স বুঝে ওঠার আগেই। এমন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার মাজেদা, সুচিত্রা, বুলবুলি, মুনমুন আদরী, ফেরদৌসী এমন অসংখ্য নাম। নতুন করে বাঁচতে শিখতে এখন তারা ‘আলোর ভুবনের’ বাসিন্দা। এমন ২১ বালিকাবধূর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যেন এক অন্যজীবনের কাহিনী।

অদম্য এই ২১ কিশোরী আলোকিত ভুবনের সন্ধানে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল চেষ্টায় শুরু করেছেন পথচলা। তাদেরও পথ দেখাচ্ছেন আরডিআরএস পরিচালিত রংপুর নগরীর আলোর ভুবন নামে একটি শেল্টার হোমের কর্মীরা। গত ১০ বছরে এ পর্যন্ত মোট ৩৪৭ জন কিশোরী এখান থেকে আলোর পথে ফিরে গেছেন। তারা এখন জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে গেছেন। তাদের সবার বাড়ি রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে।

এমন একজন বালিকাবধূ মাজেদা বেগম (১৪) জানান, সে ৪ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাড়ি লালমনিরহাট সদরে মোঘলহাট দুরাকুঠি কলমিপাড়া গ্রামে। বাবা মানিক মিয়া ঢাকায় জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মা জামিরন বেগমও থাকেন ঢাকায়। তার ভাইবোন থাকেন গ্রামে এক চাচার বাড়িতে। ঘর-সংসার, স্বামী-স্ত্রী এসব বোঝার বয়স হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়। স্থানীয় দুরাকুঠি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রতিবেশী এক চাচার মাধ্যমে বিয়ে ঠিক হয়, লালমনিরহাট শহরের ডালপট্টি গ্রামের ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী মোস্তফা মিয়া মিলন (১৮) নামের এক কিশোরের সঙ্গে। প্রথমে বাবা-মা রাজি না থাকলেও প্রতিবেশী ওই চাচা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে তাদের রাজি করেন। পরে ২০১৮ সালে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিবাহিত জীবন সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। বিয়ের সময় নগদ ৭০ হাজার টাকাসহ আসবাবপত্র দেওয়া হয়। বিয়ে ঠিকভাবে হলেও বিয়ের পরের দিনই শুরু হয় ঝামেলা। স্বামী মিলন বিয়ের পরের দিনই তাকে বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে যায়। তার একমাস পরই পুনরায় তার কাছে আসে। তখন প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে চলত ঝগড়া। কারণ ছোট থেকেই তার স্বামী নেশায় আসক্ত ছিলেন। শুধু স্বামী নন পুরো পরিবারই নেশাদ্রব্য বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এক সময় গাঁজার ব্যবসা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও খেয়েছেন। পরে কিশোর হওয়াতে তাকে যশোর কিশোর কারাগারে পাঠানো হয়। বেশ কিছুদিন সেখানেই ছিলেন। পরে ছাড়া পেয়ে আবারও নেশা সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এতে বাধা দিতে গেলেই শুরু হয় মারধর-নির্যাতন। একপর্যায়ে স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান ওই কিশোরী। বিয়ের ৯ মাসের মাথায় পরিবারের সম্মতিতে কাজীর মাধ্যমে স্বামীকে তালাক দেন। পরে চলতি বছরের জুলাই মাসে রংপুরে আলোর ভুবনে আসেন নতুন করে বাঁচতে শিখতে। এখানে তিনি সেলাই, নকশি কাঁথা, মোমবাতি তৈরিসহ হাতের কাজের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এরপর এখান থেকে ফিরে গিয়ে তিনি নিজে এসব কাজ করে আর্থিক উপার্জনের পথে নামবেন। ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে আবারো পড়াশোনা করার ইচ্ছা রয়েছে তার।

সুচিত্রা রানী রায় (১৯), তার বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার চন্দ্রখানা গ্রামে। পিতা যোগেন চন্দ্র রায় পেশায় কৃষক। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনি পড়াকালীন এক বিয়ে বাড়িতে একই উপজেলার রাবাইটারি গ্রামের দুলাল চন্দ্র রায় নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক, অতঃপর বিয়ে। দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০১৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। তখন তিনি এসএসসি পাস করেন। স্বামীর পেশা ছিল একটি কসমেটিকস কোম্পানির সেলসম্যান। বিয়ের পর কিছুদিন সংসার ভালোই চলছিল। তখন ফুলবাড়ি ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেন। একসঙ্গে সংসার ও পড়াশোনা চলতে থাকে। এরই মধ্যে সংসার জীবনে শুরু হয় নানা সংকট। স্বামী ছিলেন নেশায় আসক্ত। নেশা করে তাকে মারধর করতেন। নেশা সেবনে বাধা দিলেই নেমে আসত তার ওপর নির্যাতন। দিনদিন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। বিষয়টি পরিবারকে জানালে ঘটে আরও বিপত্তি। যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিবারের সঙ্গে। এরই মধ্যে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাবার বাড়িতে ২০১৯ সালে ফিরে আসেন। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা হয়। সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন সুচিত্রা। কিন্তু এর পরও নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে কুড়িগ্রাম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন তিনি। বর্তমানে মামলা চলমান রয়েছে। এখন সুচিত্রা আলোর ভুবনে এসে সেলাই, হাতের কাজ, পুঁতি, মোমবাতি বানানোসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। তিনি জানান, এখানে ভালো আছেন। ভবিষ্যতে পড়াশোনা করার ইচ্ছা রয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে যে কাজ শিখেছেন তা নিজের স্বপ্ন বুননে সহায়তা করবে।

এদিকে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মাধববাটি গ্রামের গরিব কৃষক আজিজুল হকের মেয়ে শারমিন আক্তার। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। বর্তমানে বয়স ১৯ বছর। ২০১৪ সালে বুনিয়াতপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে একই উপজেলার বিষুপুর গ্রামের হোটেল ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের সময় নগদ দেড় লাখ টাকাসহ স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্র ও একটি গরু দেওয়া হয়। বিয়ের পর কিছুদিন ভালো চললেও পরবর্তীতে শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ। বিয়ের পূর্বেই স্বামী নেশায় আসক্ত থাকার কারণে এই ঝগড়া-বিবাদ বাধে। শুরু হয় নানা নির্যাতন। এরই মধ্যে জন্ম নেয় এক ছেলে সন্তান। নাম রাখা হয় সিহাব বাবু। বর্তমানে ছেলের বয়স ৩ বছর। ইতিমধ্যে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে বাবার বাড়িতে চলে আসে শারমিন। ২০১৮ সালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তালাক হয় তার। দুই লাখ টাকা দেনমোহর হলেও স্বামীর পরিবার তাকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়। তিনি মামলা করতে চাইলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে মামলা করতে পারেননি। বর্তমানে শেল্টার হোমে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাউস কিপিং পদে কর্মরত রয়েছেন। সেখানে ৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান। তার ইচ্ছা রয়েছে গ্রামে গিয়ে অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলার।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বুলবুলি আক্তার (১৯)। ২ ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। গত ২০১৬ সালে  স্থানীয় অনন্তপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয় তার চেয়ে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ বড় আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী নাগেশ্বরী উপজেলার নাখারগঞ্জ গ্রামে। পেশায় ছিলেন মুদি ব্যবসায়ী। বিয়েতে তিনি রাজি না থাকলেও পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হন। এক বছর যেতে না যেতেই যৌতুকের জন্য শুরু হয় নির্যাতন। পরে ঢাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে চাকরি শুরু করেন। সেখানেও নির্যাতনের শিকার হন। কারণ স্বামী মাদক সেবন ও অন্য এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন।

সর্বশেষ খবর