শ্রী প্রসাদ ও প্রভাকর মিশ্র দুই ভারতীয় দিয়ে ঢাকা লিগে বিদেশি ফুটবলারের আগমন ঘটে। সালটি ছিল ১৯৭৪। তবে ৮০'র দশক থেকে মানসম্পন্ন বিদেশিদের আগমন ঘটে। বিদেশি বলতে তখন মোহামেডান, আবাহনী ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো বড় দলে দেখা যেত। দুই প্রধান দলে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া এশিয়ার তারকারাও খেলে গেছেন। এরমধ্যে ১৯৭৮ সালে ইরানের গোলরক্ষক নাসের হেজাজি, ১৯৮৬ সালে ইরাকের পক্ষে খেলা সামির সাকি ও করিম মোহাম্মদের নাম উল্লেখযোগ্য। হেজাজি অবশ্য এক ম্যাচ খেলে মোহামেডানের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার যোগ্য প্রশিক্ষণে ঐতিহ্যবাহী দলটি দুবার এশিয়ান ক্লাব কাপে চূড়ান্তপর্বে সুযোগ পেয়েছিল। তাছাড়া ১৯৮৯ সালে হেজাজি ইসলামাবাদ সাফ গেমসে জাতীয় দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে আবাহনীতে খেলে যাওয়ার পর পরবর্তীতে সামির সাকি আবাহনী ও মোহামেডানের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রশিক্ষণেই বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করে। উল্লেখিত খেলোয়াড় ছাড়া ইরানের নালজেগার, বিজন তাহেরী, নাইজেরিয়ার এমেকা, রাশিয়ার পলিনকভ, ঝুকভ, উজবেকিস্তানের রহিমভ, কাজাকিস্তানের কাজাকভ এমনকি শ্রীলঙ্কার পাকির আলী, প্রেমলাল ও নেপালের গণেশ থাপাও ঢাকার মাঠ কাঁপিয়ে গেছেন।
৮০'র দশক পর্যন্ত ঢাকার ফুটবল ছিল মূলত ইরান, ইরাক ও রাশিয়ান এই তিন বিদেশিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ৯০ দশকে শেষ থেকে ঢাকার ক্লাবগুলো আফ্রিকানদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পেশাদার লিগ শুরুর পরতো এ মাত্রা এতটা বেড়ে গেছে যে অন্য মহাদেশের ফুটবলারদের দেখায় মিলছে না। কথা হচ্ছে কেন, এ ব্যাপারে দলগুলো বলছে কিছু করার নেই তাদের। কারণ ইরান, ইরাক ও রাশিয়ান ফুটবলারদের যে ডিমান্ড তা কোনোভাবেই মেটানো সম্ভব নয়। তাই বলে এখনকার বিদেশিরা অর্থ যে একেবারে কম পাচ্ছে তাও বলা যাবে না। হাইতিয়ান স্ট্রাইকার সনি নর্দেকে এবার শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব আকাশ ছোঁয়া পারিশ্রমিক দিচ্ছে। যা বাংলাদেশের ফুটবলে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সত্যি বলতে কি এক সনি ছাড়া এখন ঢাকার মাঠে মানসম্পন্ন বিদেশি নেই বললে চলে। তারপরও পেশাদার লিগে ১০ দলেই চারজন করে বিদেশিরা সেরা একাদশে সুযোগ পাচ্ছেন। এ নিয়ে দেশি ফুটবলারদের ক্ষোভের শেষ নেই। মান নেই অথচ অধিকাংশ ক্লাবগুলোই বিদেশিরা কাউকে তোয়াক্কা করেন না। এক সময়ে ঢাকার মাঠে বিদেশিরা শৃঙ্খলা মেনে চললেও আফ্রিকানরা এখন পুরোপুরি উল্টো। ঢাকায় অবস্থানকালে আফ্রিকান ফুটবলাররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, ব্যবস্থা না নেওয়াতে বিদেশিদের সঙ্গে মিলে দেশি ফুটবলাররাও বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে। আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে লাভজনক ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের কোনো কোনো ফুটবলারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় দলের এক ফুটবলার বলেন, আগে বিদেশিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। এখন শৃঙ্খলাহীন বিদেশিদের সঙ্গে মিশতেই ভয় লাগে। ক্লাবগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপ করেই বিদেশিরা উড়ে আসছেন। তাদের সঙ্গে পাসপোর্টে ভুয়া ফুটবলার পরিচয় দিয়ে অনেকে বাংলাদেশের ভিসা নিচ্ছেন। ঢাকা আসার পর এদের কোনো হদিসও পাওয়া যায় না। ক্লাবগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা জড়িত থাকায় অধিকাংশ বিদেশি ফুটবলারদের ল্যাগেজ চেক করা হয় না। কেউ কেউ বলেন, এ সুযোগে তারা অবৈধভাবে মালপত্র আনতে পারছেন। জানা গেছে দুই বছর আগে দুই বিদেশি ফুটবলার নিষিদ্ধ পণ্যসহ ধরা পড়লেও প্রভাবশালী কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের কোর্টে চালান না দিয়ে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকবছর আগে মোহামেডানের এক ফুটবলারের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। মাঠে নামার আগে বিদেশিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও এটা কোনো ক্লাবই মানছে না। এ ব্যাপারে বাফুফেও নীরব। লোকালদের পারিশ্রমিক নিয়ে ক্লাব কর্মকর্তারা নয়-ছয় করলেও বিদেশিদের বেলায় তা সম্ভব নয়। পেমেন্ট বাকি পড়লেই তারা ফিফাকে অভিযোগ জানানোর হুমকি দেন। টাকা নিচ্ছেন, সে মানের পারফরম্যান্সও প্রদর্শন করতে পারছেন না। অথচ শৃঙ্খলা ভাঙার ব্যাপারে আফ্রিকানদের জুড়ি নেই। অনেক ক্লাবেই অভিযোগ করেছে এখনকার বিদেশিরা তাদের কথা শুনতে চান না। রাতে ক্লাব বা নির্ধারণ করা হোটেলে থাকার কথা থাকলেও তারা তা মানছেন না। কোথায় রাত কাটান তাও তারা গোপন রাখছেন। এমনকি কিছু কিছু ক্লাবে পুলিশ এসে তাদের বিদেশিদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। শৃঙ্খলাহীন বিদেশিদের ব্যাপারে তারপরও ক্লাবগুলো অসহায়। কারণ ব্যবস্থা নিলে মাঠে খেলোয়াড় খুঁজে পাবে কোথায়। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় এক সভাপতি জানালেন তিনি নিশ্চিত তার বিদেশিরা গোপনে অন্য দল থেকে উৎকোচ নিচ্ছেন। তাই মাঠে তাদের মনোযোগী দেখা যায় না। কেউবা ইচ্ছাকৃতভাবে হট্টগোলে জড়িয়ে লালকার্ড পেয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। বাফুফেও এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। তাদের কথা শৃঙ্খলাহীন বিদেশিদের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ার দায়িত্ব ক্লাবগুলোর। এখানে তাদের কিছু করার নেই।