সর্বকালের গোলরক্ষকের কথা উঠলেই সামনে চলে আসে কয়েকটি নাম_ সোভিয়েত ইউনিয়নের লেভ ইয়াসিন, জার্মানির অলিভার কান, ইংল্যান্ডের গর্ডন ব্যাঙ্কস, ইতালির দিনো জফ। তবে স্পেনের ইকার ক্যাসিয়াসের নামটা থাকবে সবার উপরেই। স্পেনকে তিনি দুই দুইবার ইউরো কাপের শিরোপা এনে দিয়েছেন, একবার বিশ্বকাপও। যদিও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করলে গোলরক্ষক হিসেবে এই মুহূর্তে ক্যাসিয়াসকে এক নম্বরে রাখা খানিকটা পক্ষপাতিত্বই হয়ে যায়! তবে গোলরক্ষকের সঙ্গে অধিনায়ক যুক্ত হলে 'ক্যাসিয়াস' অদ্বিতীয় এক নাম।
ব্রাজিল বিশ্বকাপটা ক্যাসিয়াসের জন্য 'বিশেষ কিছু'। অধিনায়ক হিসেবে যেমন ইতিহাস গড়ার হাতছানি রয়েছে, তেমনি গোলরক্ষক হিসেবেও সর্বকালের সেরা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ম্যারাডোনা, দুঙ্গা, কাফু, ম্যাথিউস -বিশ্বকাপে একাধিকবার তাদের দলকে নেতৃত্ব দিলেও কেউ-ই অধিনায়ক হিসেবে তার দলকে একাধিক শিরোপা এনে দিতে পারেননি। তাই এবার গোলপোস্টে দ্যুতি ছড়িয়ে ক্যাসিয়াস যদি স্পেনকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেন তবে একসঙ্গে পেয়ে যেতে পারেন দুটি খেতাব-'সর্বকালের সেরা অধিনায়ক' এবং 'সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক'!
এখন পর্যন্ত সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়াসিনকেই ভাবা হয়। তিনি গোলরক্ষকের পাশাপাশি একজন ডিফেন্ডারের ভূমিকা পালন করতেন। অলিভার কানের হাতকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ানো মোটেও সহজ ছিল না। ২০০২ বিশ্বকাপে এই জার্মান তারকা দেখিয়ে দিয়েছেন একজন গোলরক্ষক হয়েও বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার 'গোল্ডেন বল' জেতা যায়। এক চোখে সমস্যা গর্ডন ব্যাঙ্কস তো ১৯৬৬ বিশ্বকাপে বাজিমাৎ করে দেন। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ডান দিকে শূন্যে লাফিয়ে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের যে গোলটি সেভ করেছেন, সেটিকে বলা হয় 'শতাব্দীর সেরা সেভ'। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে দিনো জফের ক্যারিশমাতেই শিরোপা জিতেছিল ইতালি। সেবার আজ্জুরি দলের নেতৃত্বের ভারও ছিল তার কাঁধেই। ৪০ বছর ৪ মাস বয়সে 'অতন্দ্র প্রহরী' জফ ইতালিকে ৪৪ বছর পর বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিয়ে পৌঁছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
স্পেনের ইকার ক্যাসিয়াসও কারো চেয়ে কম নন। টানা তিন আসরে 'ইউরো কাপ-বিশ্বকাপ-ইউরো কাপ' জয় করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। ক্যাসিয়াস যেভাবে একের পর এক নিশ্চিত গোল সেভ করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। তাছাড়া মাঠে তিনি যে শুরু গোলবার-পোস্ট নিয়ে পড়ে থাকেন তা কিন্তু নয়। শরীরটা গোলবারের নিচে পড়ে থাকলেও ক্যাসিয়াসের বিচরণ তো মাঠ জুড়েই। অধিনায়ক বলে কথা! আর অধিনায়ক হিসেবেই স্পেনকে দুইটি ইউরো শিরোপা এবং বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। তাই সর্বকালের সেরা 'গোলরক্ষক' কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এবারের বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা 'অধিনায়কের' তকমাটা পেয়েই যেতে পারেন ক্যাসিয়াস! যদি ব্রাজিলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় স্পেন! কেননা এখন পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে দুইবার শিরোপা জিততে পারেনি কোনো খেলোয়াড়-ই। তাছাড়া গোলরক্ষক হিসেবে দুই ইউরো এবং বিশ্বকাপ জিতে 'সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক' তকমাটাও নিজের দখলে নিতে পারেন তিনি। তাই এবার ক্যাসিয়াসের সামনে ইতিহাস গড়ার হাতছানি।
অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ তিনবার বিশ্বকাপ খেলেছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দায়িত্ব নিয়ে বাজিমাৎ করেন। একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দেন। ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ছিলেন ম্যারাডোনা। তবে ৯০-এ আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নিয়ে গেলেও একটুর জন্য শিরোপা জিততে পারেননি। লোথার ম্যাথিউসও দুই বিশ্বকাপে জার্মানির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৯০-এ শিরোপা জিতলেও ৯৪-এ পারেননি। ব্রাজিলের কার্লোস দুঙ্গাও অধিনায়ক হিসেবে দুই বিশ্বকাপ খেলেছেন। ৯৪-এ ব্রাজিলকে শিরোপা এনে দিলেও ৯৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে যায়। ব্রাজিলের কাফুও দুই বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০২ সালে তিনি ব্রাজিলকে শিরোপা এনে দেন। তিনি ২০০৬ সালেও সাম্বার দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত ম্যারাডোনা ও দুঙ্গাই বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক, যারা অধিনায়ক হিসেবে দুইবার করে ফাইনাল খেলেছেন। তবে এবার ক্যাসিয়াস স্পেনকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারলে দুইবার চ্যাম্পিয়ন দলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি-ই হয়ে যাবেন সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। ব্রাজিল জয় করতে পারলে আরেকটি ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে ক্যাসিয়াস ও স্পেন, এর আগে ইউরোপের কোনো দেশই লাতিন আমেরিকায় গিয়ে শিরোপা জিততে পারেনি। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো টানা তিন বিশ্বকাপে আধিপত্য স্থাপিত হবে ইউরোপের!
ইকার ক্যাসিয়াস বর্তমানে স্পেনের হয়ে সবচাইতে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়। ২০০০ সালের ৩ জুন, মাত্র ১৯ বছর ১৪ দিন বয়সে জাতীয় দলের হয়ে সুইডেনের বিপক্ষে তিনি মাঠে নামেন। নিয়মিত গোলরক্ষক সান্তিয়াগো ক্যানিজারেসের ইনজুরির কারণে সবচেয়ে কম বয়সী গোলরক্ষক হিসেবে ২১ বছর বয়সে অভিষেক ঘটে ২০০২ বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো পেনাল্টি শট সেভ করায় পেয়ে যান 'সেইন্ট ইকার' উপাধি। এরপর থেকে স্পেন দলে ক্যাসিয়াস ক্যারিশমা চলছেই।