ঢাকার নাগরিক জীবনে নানাবিধ সমস্যা নিয়ে আমরা বসবাস করছি। ঢাকায় ফুটওভার ব্রিজ যে জায়গাগুলোতে প্রয়োজন সেখানে রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং নেই। যদি ক্রসিং থাকে সেখানে কোনো না কোনো সময় রাস্তার গাড়িগুলোকে থামতে হয়। যেদিকের গাড়ি থামবে সেদিক দিয়ে জেব্রাক্রসিং পার হবে। ঢাকা শহরে আমরা দেখেছি ৮০ শতাংশ ফুটওভার ব্রিজই এমন জায়গায় দেওয়া হয়েছে যেখানে জেব্রাক্রসিং থাকার কথা। কিন্তু এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় কারণ যেখানে জেব্রাক্রসিং থাকে সেখানে মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে আগ্রহী হয় না। আমি মনে করি জেব্রাক্রসিং সঠিকভাবে দেওয়া হলে ঢাকার বহু ফুটওভার ব্রিজ সরানো যেত এবং সেটা প্রয়োজনীয় জায়গায় দেওয়া সম্ভব হতো। আমাদের যেখানে ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রাক্রসিং দরকার সেখানে তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমন্বিতভাবে কোনো কিছুই আমরা করছি না। ঢাকায় অনেকগুলো রাস্তা যেখানে একত্রিত হয় সেখানে পুলিশের অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এ ধরনের রাস্তায় গাড়িগুলোর টার্ন নেওয়ার জন্য বেশি জায়গা রাখা হয়। কিন্তু পুলিশের অনেক লোকই জানে না যে, গাড়ি টার্ন নেওয়ার জন্য বেশি জায়গা প্রয়োজন। পৃথিবীর বহু দেশ আছে গাড়ি টার্ন নেওয়ার যে জায়গা সেখানে কোনো গাড়ি বা মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু ঢাকার অনেক টার্নিং স্থানেই দেখা যায়, পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
ঢাকায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ফুটপাথ অবৈধভাবে দখলে। তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে ফুটপাথ থেকে এ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। ফুটপাথের অবৈধ ৫০ হাজার লোকের কারণে ঢাকায় ৫০ লাখ ফুটপাথ ব্যবহারকারীকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা এ ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন অর্থ আদায় করেন। তবে সমস্যার সমাধানে আমাদের প্রথমেই সড়ক ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
ঢাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। কারণ পুরো শহরে অসংখ্য গ্যাসের লাইন মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। এর প্রকৃত নকশা এবং তা বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা থেকে ১০০ কি.মি. দূরে ছয় থেকে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই গ্যাসের পাইপগুলো বিস্ফোরিত হবে। এমনকি নেপালের মতো আমাদের দেশে ছড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের লাইনগুলোও তখন গ্যাস লাইনের সঙ্গে লেগে ‘স্পার্ক’ করবে। যা কিনা আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হবে। এ পরিস্থিতি ঠেকাতে গ্যাস পাইপে ‘অটো সেন্সার’ লাগাতে হবে। এই অটো সেন্সার লাগানো থাকলে গ্যাস পাইপের ওপর ভূমিকম্পের চাপ পড়লে তা সক্রিয়ভাবে গ্যাসের লিক হয়ে যাওয়া বন্ধ হবে। ফলে বিস্ফোরণ ঠেকানো যাবে।
আমাদের এ রাজধানীর মতো মেগাসিটিতে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার অবসানে এখানে নগর সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। ঢাকা মহানগরীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাজ করে ৫৪টি সংস্থা। এ ৫৪টি সংস্থা সাতটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উল্লিখিত সংস্থাগুলোর মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। সে সব জটিলতার অবসান না হলে যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপক সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নেও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। প্রতিটি সংস্থার বিধিবিধানে উল্লেখ রয়েছে, অন্য সংস্থার বিধিবিধানে যাই উল্লেখ থাকুক, যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। প্রতিটি সংস্থার বিধিবিধানেই এ কথা উল্লেখ আছে। তাই নিজ নিজ সংস্থার বিধিবিধান অনুসারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। এ বিষয়ক বিভিন্ন কাজে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় জরুরি। আমরা লক্ষ করেছি, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জনগণের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। একবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি শুরু হলে তা যেন সহসা শেষ হতেই চায় না। লক্ষ করা যায়, কোনো একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষে রাস্তা মেরামতের মাত্র কিছুদিন পর অন্য এক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। এভাবে কোনো কোনো রাস্তায় বছরের বেশিরভাগ সময় জনদুর্ভোগ লেগেই থাকে। অথচ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় থাকলে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করত না। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকলে অর্থের সাশ্রয় হতো। নিয়ম না মেনে যেসব প্রতিষ্ঠান রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জনগণ এটাই দেখতে চায়।
রাজধানীতে চলার পথে নগরবাসী প্রতিদিন যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন তার অন্যতম যানজট। এ সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা থেকে নগরবাসীর পরিত্রাণের বিষয়টি নির্ভর করছে নগর সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর। নগর সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে নগরবাসীর বহুমুখী ভোগান্তির অবসান হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। অনেক দেশেই মেয়রের নেতৃত্বে নগর সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সেসব উদাহরণ সামনে রেখে বাংলাদেশে নগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসীর বহুমুখী ভোগান্তির অবসান হবে এমনটা আশা করা যায়।
ঢাকার উন্নয়ন করতে হলে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিভক্তের মাধ্যমে একজন মানুষকে যেন দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। একটি শহর ১০ খণ্ডও হতে পারে। কিন্তু সেই খণ্ডিত শহরের উন্নয়ন করতে হলে সেগুলোকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে। যিনি মেয়র নির্বাচিত হবেন, তাকে প্রথমত নিজের ক্ষমতাকে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে হবে। আর সেটি করার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ মৌলিক সমস্যাগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। দরকার হলে প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। মেয়রকে নগরবাসীর নার্ভ বুঝতে হবে। মহিলাদের পাবলিক টয়লেট থেকে শুরু করে যত ধরনের বাস্তবসম্মত সমস্যা রয়েছে তার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঢাকা একমাত্র শহর যার চারপাশে নদী। অথচ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এই ঐশ্বর্য আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এই নদীগুলো যেন বানরের গলায় মুক্তোর মালা। সদিচ্ছা থাকলে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকাকে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম এক সুন্দর শহরে পরিণত করা সম্ভব। হাতিরঝিল তার বড় প্রমাণ। ঘরের মাঝখানে মিষ্টি রাখলে পিঁপড়া আক্রমণ করবেই। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখে শুধু এককেন্দ্রিক উন্নয়ন না করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষম উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। ঢাকার উন্নয়ন করতে মেয়রকে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে। এক সপ্তাহের পরিচ্ছন্নতা অভিযান নয়, পাঁচ বছরের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তাহলে এক বছরেই ঢাকার চেহারা বদলে যাবে। এক মেয়র মশা নিধন করল, আরেকজন চাষ করল, তাহলে লাভ কী? বিভক্ত করে উন্নয়ন হয় না।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট।
 
                         
                                     
                                                             
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        